পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা
উনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে পাশ্চাত্য শিক্ষা-দীক্ষা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে বাংলার সমাজ ও ধর্ম জীবনে এক প্রবল ভাবাবেগ ও আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। মধ্যযুগীয় কুসংস্কারচ্ছন্ন এবং কুপমন্ডুকতা থেকে সাধারণ মানুষকে সরিয়ে এনে পাশ্চাত্য শিক্ষার জ্ঞান ও দর্শনের দ্বারা মানুষ যাতে শিক্ষিত হতে পারে সে বিষয়ে সেই সকল ব্যক্তিবর্গ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। দেশ ও জাতিকে এই মহান লক্ষ্যে উত্তীর্ণ করার ব্রত গ্রহণ করেছিলেন ভারত পথিক রামমোহন রায় । বলাই বাহুল্য দেশের সমস্ত ধর্মের মানুষই এটা সুনজরে দেখেননি, এমনকি ডিরোজিওপন্থিরাও রামমোহনের পদক্ষেপ সমর্থন করেননি।
সমাজ সংস্কারে কাজে রামমোহন এর মূল উদ্দেশ্য ছিল কুসংস্কার ও অজ্ঞতার অন্ধকার দূর করে সাধারণ মানুষকে সত্যের পথ দেখানো। এই কাজটি একমাত্র শিক্ষা বিস্তারের পক্ষেই সম্ভব তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। কেবলমাত্র পুঁথিগত বিদ্যা আয়ত্ত করে তাত্ত্বিক তৈরি করা তার উদ্দেশ্য ছিল না; পাশ্চাত্য বিজ্ঞান রাষ্ট্রনীতি অর্থনীতি আইন প্রভৃতি আধুনিক শিক্ষার মাধ্যমে ভারতবাসীকে পরিচিত করার লক্ষ্যে রামমোহন অবতীর্ণ হন। এই কারণেই তিনি ভারতে ইংরেজি শিক্ষা ও পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারিত পক্ষপাতী ছিলেন। ভারতীয়দের মানসিক বিকাশের জন্য তিনি ইংরেজদের সাথে ঘনিষ্ট হওয়ার কথা বলেছেন কলকাতার টাউন হলে রামমোহন চেয়েছিলেন ইংরেজরা ভারতে এসে বসবাস করুক কারণ এর ফলে স্কুল-কলেজ স্থাপিত হবে
পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার আরামবাগ মহকুমার অন্তর্গত খানাকুল থানার রাধানগর গ্রামে ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে রাজা রামমোহন রায় জন্মগ্রহণ করেন। বিভিন্ন ভাষায় পারদর্শী রামমোহনের শিক্ষার মূল লক্ষ্য ছিল জাগতিক ও সমাজ কল্যাণ বিষয়ক। মূলত মধ্যযুগের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষকে শিক্ষার আলোয় পর্যবসিত করাই ছিল তার প্রধান লক্ষ্য।
রামমোহনই প্রথম বুঝেছিলেন যে ভারতে সত্যিকারের উন্নতি নির্ভর করছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষা সংস্কৃতি সমন্বয়ের উপর। তিনি হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতিকে ত্যাগ করেননি বরং পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞানের ভালো দিকগুলি গ্রহণ করে নিজের দেশের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করতে বলেছিলেন। ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ স্থাপনের সময় যখন গোড়া হিন্দুরা তাকে প্রস্তাবিত কমিটিতে রাখার জন্য বিরোধিতা করেন তখন রামমোহন সেখান থেকে সরে এসে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করে তোলেন।
অপরদিকে খ্রিস্টান মিশনারী আলেকজান্ডার ডাফ যখন কলকাতায় ইংরেজি শিক্ষার জন্য একটি স্কুল বাড়ি খোঁজ করছিলেন তখন রামমোহন শুধু তার জন্য বাড়ি খুঁজেই দেননি, তার সাথে পর্যাপ্ত শিক্ষার্থীও দিয়েছিলেন। হিন্দু কলেজ কমিটি থেকে সরে গিয়ে বাঙালি হিন্দু ছেলেদের ইংরেজি শিক্ষা দেওয়ার অভিপ্রায় ১৮২২ সালে তিনি অ্যাংলো হিন্দু স্কুল স্থাপন করেন। এই স্কুলের পার্থ তালিকায় কারিগরিবিদ্যা জ্যোতির্বিজ্ঞান জ্যামিতি অন্তর্ভুক্ত ছিল।
১৮২৩ সালে আর্মহারস্ট কে লেখা চিঠিতে রামমোহন রায় ভারতের পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের কথা বলেন। ফলে তো ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে এদেশে শিক্ষার প্রসারের জন্য জেনারেল কমিটি অফ পাবলিক ইন্সট্রাকশন প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংস্থার উপর দায়িত্ব পড়ল সরকারি বরাদ্দ অর্থ ব্যয়ের। দীর্ঘ 12 বছর পর ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে বেন্টিং ও মেকলে রামমোহনের মতকেই গ্রহণ করে পাশ্চাত্যের পাশাপাশি প্রাচ্য শিক্ষার কেউ ব্রাহ্মণ গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেন।
তার প্রচেষ্টাই ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে উডের ডেসপ্যাচ এ প্রাচ্য শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত হয়। এছাড়াও ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে রামমোহন ‘বেদ বিদ্যালয়’ স্থাপন করেন। এখানে হিন্দু দর্শন ও সাহিত্যের সাথে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও সাহিত্য পড়ানো হতো। তবে রামমোহন নারী শিক্ষা বিষয়ে বিশেষ আলোকপাত করেননি। এ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মত পার্থক্য বিদ্যমান। তিনি যে নারী শিক্ষা বিষয়ে একেবারেই উদাসীন ছিলেন তা বলা চলে না।
গৌর মোহন বিদ্যালঙ্কারের ‘স্ত্রী-শিক্ষা বিধায়ক‘ তারই প্রভাবে লিখিত হয়েছিল। ডঃ নিমাইসাধন বসু বলেছেন যে, হিন্দু সমাজের গোড়ামী ও রক্ষণশীল সমাজপতিদের সম্ভাব্য বিরোধিতার কথা চিন্তা করে তিনি এগোতে সাহস পাননি। এ কথাটিও যুক্তিযুক্ত নয় কারণ যে ব্যক্তিকে সারা জীবন রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছিল তিনি এগোতে সাহস পাননি এটি মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু যাইহোক ১৯ শতকের শিক্ষা তথা সমাজের সর্বক্ষেত্রে যে নতুন যুগে সৃষ্টি হয়েছিল তার অন্যতম পথিকৃৎ ব্যক্তি হলেন রামমোহন রায়। পরবর্তী কালের সব মনীষী তার পথ অনুসরণ করেছেন তাই তাকে যথার্থই ‘ভারত পথিক’ আখ্যা দেয়া হয়েছে।
<-আরও পড়ুন ->
- নূরজাহান চক্র কি
- পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা
- রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত কি ? বৈশিষ্ট্য প্রভাব ও ফলাফল
- আলাউদ্দিন খলজির বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা
- অশোকের ধম্ম নীতি
*Topic Covered :-
পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা, পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা আলোচনা করো, পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা আলোচনা করো, শিক্ষা বিস্তারে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা ।