এলাহাবাদ প্রশস্তি
প্রাপ্তিস্থান : প্রথমে এই ৩৫ ফুট উঁচু স্তম্ভটির অবস্থান ছিল উত্তরপ্রদেশের কৌশাম্বি অর্থাৎ বর্তমান কোসামে পরে এটিকে সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক এর বর্তমান অবস্থান উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদ দুর্গে নিয়ে আসেন। এর গায়ে সম্রাট অশোকের কৌশম্বি অনুশাসন ও দেবী অনুশাসন উৎকীর্ণ আছে । এই অভিলেখের ৩৩ টি পংক্তির মধ্যে প্রথম তিনটি এমন ভাবে ভেঙে চুরে নষ্ট হয়ে গেছে যে কয়েকটি অক্ষর বাদে তাদের পাঠোদ্ধার অসম্ভব।
লিপি : দীনেশচন্দ্র সরকার এই অভিলেখের লিপিকে উত্তর কালীন উত্তরভারতীয় শ্রেণীর ব্রাহ্মী বলে নির্দেশ করেছেন। ইদানিং কালে ব্রাহ্মী লিপির আদিগুপ্তযুগীয় ও গুপ্ত যুগীও এই দুটি শ্রেণি প্রকল্পিত হয়। তার মধ্যেও আবার আঞ্চলিক লিখনশৈলির প্রভেদ অনুযায়ী এই লিপির বিবর্তন বিশ্লেষণ করার প্রয়াস হচ্ছে আলপচ্য প্রশস্তির ব্রাহ্মী লিপিতে সেই বিস্তার বিচারে আদি গুপ্ত যুগের কৌশল লক্ষণীয়।
ভাষা : এই প্রশস্তিটির ভাষা সংস্কৃত। খাদ্যটপাকিক, শান্তিবিগ্রহিক, কুমারামাত্য, মহাদণ্ডনায়ক – এতগুলি ভারী ভারী পদের প্রশাসনিক দায়িত্ব যার কাঁধে সমুদ্রগুপ্ত নির্দ্বিধায় ন্যাস্ত করেছিলেন সেই হরিষেন এই প্রস্তুতির কবি। তিনি স্বয়ং এই প্রস্তুতিকে কাব্য সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করেছেন অভিলেখ সাহিত্যের নিরিখে তো বটেই সমগ্র সংস্কৃত সাহিত্যেও এই প্রশস্তির কাব্য সম্পদের সঙ্গে প্রতিস্পর্ধা করার মতন রচনা হাতে কোন কয়েকটা মাত্র। গদ্য পদ্যের সুষম মিশ্রণে এই কাব্য অলংকার শাস্ত্রের ভাষায় চম্পূ নামে অভিহিত হওয়ার যোগ্য তবে এই প্রসস্তিতে লিপি ও ব্যাকরণগত ত্রুটি না থাকলেও লিপিকর প্রমাদ অনেক জায়গায় রয়েছে।
বিষয়বস্তু : প্রবল পরাক্রান্ত গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের বহুমুখী প্রশংসায় এর প্রতিপাদ্য। তার শৌর্য বীর্য, তার দিক্বিজয়, তার রাজকীয় ও আভিধানিক গুণাবলী, বংশ পরিচয় – এই সব কিছুর চলচ্চিত্রবৎ চিত্রনের শেষে রয়েছে প্রশস্তির ধারক স্তম্ভ টির সালংকার উল্লেখ ও কবি বিনীত আত্মপরিচয় কবির কথায় সমুদ্রগুপ্তের সান্নিধ্য তার বুদ্ধির উন্মেষ ঘটিয়েছে। এই প্রশস্তি টি মৌর্য সম্রাট অশোকের অনুশাসন চিহ্নিত স্তম্ভে উৎকীর্ণ অশোকের অনুশাসনের থেকে এই প্রশস্তির মানসিকতার মৌলিক প্রভেদ রয়েছে অশোকের রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রভাব ছিল অনেক বেশি অঞ্চলের উপর বিস্তৃত কিন্তু সেই ক্ষমতার ঘোষনাই তিনি যথেষ্ট বিনয়ের পরিচয় দিয়েছেন অন্যদিকে দ্বিগবিজয়ী সমুদ্রগুপ্তের আদর্শ ছিলেন মহাপদ্মনন্দ, অশোক নয়। তাই রোমিলা থাপারের বিশ্লেষণ অনুযায়ী সমুদ্রগুপ্ত হয় অশোক উত্তর এক ঐতিহাসিক অনুবৃত্তি দাবি করবার জন্য অথবা অশোকের মতবাদের বিরোধী রূপে নিজেকে অবস্থানকে স্পষ্টত নির্দেশ করার জন্য এই স্তম্ভটিকেই বেছে নিয়েছিলেন। এমন হতে পারে আর্যাবর্ত ও দাক্ষিণাত্যের রাজাদের পরাজিত করে যে সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত সমরাভিযান, যশ প্রবৃত্ত লাভ করেছিলেন তার মহিমা অশোক কেও অতিক্রম করে গেছে। এটা দেখানোর উপায় হিসেবে এই স্তম্ভকে তার প্রশস্তির আধার করা হয়েছিল।
এই অভিলেখের শেষের দিকে ২৮-২৯ পংক্তিতে সমুদ্র গুপ্তের বংশপরিচয় বিবৃত হয়েছে। বলা হয়েছে, তিনি মহারাজ শ্রীগুপ্তের প্রপৌত্র, মহারাজ শ্রী ঘটোৎকচ এর পৌত্র, মহারাজাধীরাজ শ্রী চন্দ্রগুপ্তের পুত্র, লিচ্ছবি দৌহিত্র ও মহাদেবী কুমারদেবীর গর্ভে জাত। অর্থাৎ গুপ্ত নামক কোন রাজাকে এই বংশের আদি পুরুষ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে যিনি কেবল মহারাজ উপাধিতে ভূষিত অর্থাৎ যিনি সার্বভৌম নরপতি ছিলেন না। তার উত্তরসূরী ঘটোৎকচের ব্যাপারেও একই কথা। এই বংশের প্রথম স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজা প্রথম চন্দ্রগুপ্ত যাকে মহারাজাধীরাজ উপাধিসহ উল্লেখ করা হয়েছে। বিষ্ণুপুরাণে ও শ্রীগুপ্ত, ঘটোৎকচ ও চন্দ্রগুপ্তকেই প্রথম গুপ্ত শাসকত্রয় বলা হয়েছে। প্রথম চন্দ্রগুপ্ত সিংহাসনে বসার পর ওই ঘটনার স্মারক হিসেবে ৩১৯-৩২০ খ্রিস্টাব্দে নতুন এক অব্দের প্রচলন করেন যাকে গুপ্তাব্দ বলা হয়। তিনি বৈশালীর লিচ্ছবি রাজকন্যা কুমারদেবীকে বিবাহ করেন। তার বা সমুদ্রগুপ্তের আমলে গুপ্ত রাজাদের যে স্বর্ণমুদ্রা প্রচলিত হয় তার মুখ্য পাশে দন্ডায়মান অবস্থায় প্রথম চন্দ্রগুপ্ত ও কুমারদেবীর যুগল প্রতিকৃতি মুদ্রিত। গৌণ পাশে দেখা যায় লক্ষ্মী মূর্তির সঙ্গে ‘লিচ্ছবয়ঃ’ এই অক্ষর গুলি উৎকীর্ণ আছে। বহুবচনে প্রযুক্ত এই শব্দ বুঝিয়ে দেয় যে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে অজাত্রুর হাতে সম্পূর্ণ পর্যদুস্ত হওয়া সত্বেও খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর প্রথম দিকে গণরাজ্য রূপে লিচ্ছবিদের বিশিষ্ট অস্তিত্ব ছিল। কুমারদেবীর সঙ্গে বিবাহ চন্দ্রগুপ্তের রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধির সহায়ক হয়েছিল এর ফলে উত্তরবিহারের বৈশালী গুপ্ত অধিকারভুক্ত হয়ে থাকতে পারে এই বিবাহ এতটাই গুরুত্ব বহন করত যে সমুদ্রগুপ্তের পরিচয় দেওয়ার সময় তার মাতামহকুলের উল্লেখ প্রশস্তিকারের কাছে অপরিহার্য মনে হয়েছে।
এই অভিলেখের চতুর্থ শ্লোকটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব দিক থেকে অতুলনীয়। প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে সাধারণত জ্যেষ্ঠ পুত্রদেরই পিতার পর রাজপদে অভিষিক্ত হতে দেখা যায় কিন্তু এই নিয়ম যে সবসময় অনুসৃত হতো তা নয়। সেই রকম এক বিরল দৃষ্টান্ত উপস্থাপিত করে এই শ্লোক।
প্রথম চন্দ্রগুপ্ত কর্তৃক সমুদ্রগুপ্তকে উত্তরাধিকারী নির্বাচন করেছিলেন এই যুগান্তকার ঘটনাটি এই শ্লোকে চিত্রিত হয়েছে। ভারত ইতিহাসের এই যুগান্তকারী ঘটনাটি এই শ্লোকে চিত্রিত এই বর্ণনা থেকে বোঝা যায় সমুদ্রগুপ্ত চন্দ্রগুপ্তের জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন না। যার ফলে সিংহাসনে দাবিদার অন্যান্য রাজপুত্র ও সভাসদদের সাক্ষাতে তার উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠার আয়োজন হয়েছিল। প্রথম চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যচ্যুতির কথা ইতিহাসের অন্য আকরেও আছে। আলোচ্য প্রশস্তির পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্লোক থেকে কেউ কেউ মনে করেন সমুদ্রগুপ্তের রাজত্বকালের প্রথম দিকে কোন রাজনৈতিক দুর্যোগ দেখা দেয়। এই শ্লোকগুলির যে খন্ডিত উদ্ধার সম্ভব হয়েছে তার থেকে মনে হয় সমুদ্রগুপ্ত কোন প্রতিদ্বন্দ্বীকে তার অসাধারণ বীর্য বর্তার দ্বারা পীড়িত করেছিলেন ও কাউকে কাউকে প্রবল বিক্রমে বশীভূত করেছিলেন। অনুমান হয় কোন জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে উত্তরাধিকার নির্বাচন করতে হয়েছিল বলে বৃদ্ধ চন্দ্রগুপ্ত ভাবাবেগে আকুল হয়ে পড়েছিলেন। সমুদ্রগুপ্তের সিংহাসন লাভের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন কাচ নামে এক অনিশ্চিত পরিচয় রাজকুমার- এমন অনেক পন্ডিত বলে থাকেন। কাচের নামাঙ্কিত মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। কেউ কেউ কাচকে সমুদ্রগুপ্তের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বলেছেন। তিনি কিছুকাল রাজত্ব করে মুদ্রা প্রচার করেন বলে এরা মনে করে। ভান্ডারকরের মতে তিনি রাম গুপ্ত, কিন্তু হেমচন্দ্র রায় চৌধুরীর মতে কাচ সমুদ্রেরই নামান্তর কারণ কাচের মুদ্রায় তার বিশেষণ ‘সর্বরাজউচ্ছেতা’ যা গুপ্ত রাজাদের যাবতীয় সরকারের নথিতে একমাত্র সমুদ্রগুপ্তেরই বিশেষণ মূলক উপাধি। দীনেশচন্দ্র সরকারও এই মত সমর্থন করেছেন, তার মতে প্রথম জীবনে সমুদ্র গুপ্তের নাম ছিল কাচ। এলান সাহেবের মতে দ্বিগবিজয় প্রসঙ্গে কাচ পিতার নামের সঙ্গে সাদৃশ্য বজায় রেখে পরিকল্পিত সমুদ্রগুপ্ত এই নাম ধারণ করেছিলেন। ‘আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প’ গ্রন্থ অনুযায়ী সমুদ্রগুপ্তের ভস্ম নামে এক কনিষ্ঠ ভ্রাতা ছিল। তিনি ছিলেন দুষ্ট ও মন্দবুদ্ধি এবং তিন দিন মাত্র রাজ্য শাসন করেছিলেন। উইলিয়ামস এর মতে ভস্ম ও কাচ সমার্থক। যাইহোক আলোচ্য শ্লোকের ‘তুল্যকুলজ’ কুমারদের ম্লানাননের উল্লেখ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে সিংহাসনের আরো দাবিদার ছিলেন যাদের অতিক্রম করে নিজ যোগ্যতার কারণেই সমুদ্রগুপ্ত তার পিতার সর্বাপেক্ষা আস্থাভাজন হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।
সমুদ্রগুপ্তের দিকবিজয় এই প্রশস্তির অন্যতম প্রধান বর্ণনীয় বিষয়। দক্ষিণাপথ, আর্যাবর্ত রাজ্য, প্রত্যন্ত দেশ, কৌমগোষ্ঠী বা উপজাতি রাজ্য, বৈদেশিক রাজন্য ও দীপবাসীদের উপর সমুদ্রগুপ্তের একাধিপত্য ও প্রভাব বিস্তার এর প্রমাণ। এতে বিবৃত পরাজিত ও বশীভূত রাজাদের সঙ্গে তার রাজনৈতিক সম্পর্কের উপরেও আলোকপাত করে এই প্রশস্তি। আমরা অনুমান করতে পারি এই সম্রাট তার সাম্রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধির চেয়ে বিজিত রাজ্যগুলিকে করদরাজ্যে পরিণত করার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী ছিলেন। কেবল যে নয় জন আর্যাবর্ত রাজ মলিন হয়েছিলেন তাদের রাজ্যগুলি তার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। দক্ষিণ ভারতের ক্ষেত্রে তার দ্বিগবিজয় ছিল ধর্মবিজয়।
এই ধর্ম বিজয় অশোকের ধর্ম বিজয় নয়, কৌটিল্যের কথিত ধর্ম বিজয়ের সমার্থক ১২ জন দাক্ষিণাত্যের রাজাকে পরাজিত করেও তাদের রাজ্য তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন। পূর্ব ভারত ও নেপালের রাজারা এবং পাঞ্জাবের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলির অধিপতিরা করদানে প্রতিশ্রুত হয়ে অধীনতার প্রমাণ দেয়। প্রাচীন মালব সহ নটি গণসংঘ তার বশ্যতা স্বীকার করে দৈবপুত্রশাহানুসায়ী, শক, মুরুন্দ, সিংহলরাজ ও সর্বদ্বীপবাসী তার সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে। ১৯ থেকে ২২ নম্বর পংক্তি এই দিকবিজয়ের বর্ণনায় উৎসর্গ করা হয়েছে। কিন্তু তার আগেও ১৩ ও ১৪ পংক্তিতে বলা হচ্ছে অচ্যুত নাগসেন ও ‘গ’ বিশিষ্ট রাজাকে সমুদ্রগুপ্ত উন্মলিত করে। পাটলিপুত্রে ক্রীড়া করতে করতে এক রাজপুত্র বা রাজাকে বন্দী করেন। দীনেশচন্দ্র সরকারের মতে সে রাজাটি হলেন গণপতিনাগ যার নাম অচ্যুত, নাগসেন এর সঙ্গে উৎপাটিত আর্যাবর্ত নরপতিদের তালিকায় উল্লেখিত। কতগুলো রাজার সম্পূর্ণ পরিচয় জানা যায় না। কোত বংশ বলতে সুনীল চট্টোপাধ্যায় মতে বুলন্দ শহরের শাসক কোটা পরিবার। কেউ কেউ কোত বলতে কোচ জাতিকে বোঝেন, কারো কারো মতে কোত হল কোচবিহার। পূর্ব পাঞ্জাব ও দিল্লির সাধারণভাবে প্রাপ্ত কোত উপজাতির মুদ্রার প্রতি স্মিথ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। নীলগিরি পর্বতেও এক কোত উপজাতির অস্তিত্ব ছিল বলে জানা যায়। রাফসন ‘কোত’ এই শব্দ উৎকীর্ণ মুদ্রা সমুহের উল্লেখ করেছেন যেগুলি শ্রাবস্তীর জনৈক রাজার স্রুত মুদ্রার অনুরূপ ও উচ্চ গাঙ্গেয় অঞ্চলের বলে মনে করা হয়। আলোচ্য প্রশস্তির প্রামাণ্যে কেউ কেউ মনে করেন কোত বংশ ওই সময়ে পুষ্প নামক নগরে পাটলিপুত্রে শাসন করত। সম্ভবত পাটলপুষ্পের প্রাচুর্যের কারণে পাটলিপুত্রকে প্রায়শই পুষ্পপুর, পুষ্পপুর্ কুসুমপুর ইত্যাদি নামে উল্লিখিত হতে দেখা যায়। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে কুসুমপুর, পুষ্পপুর ও পাটলিপুত্র একই স্থানকে বোঝাত বলে অধিকাংশ পন্ডিত মনে করেন। আলোচ্য উল্লেখ থেকে এমন মনে করাও অসমচীন নয় যে পাটলিপুত্র ওই সময়ে সমুদ্রগুপ্তের রাজধানী ছিল পরে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের দ্বারা শকেরা পশ্চিম ভারত থেকে উচ্ছিন্ন হলে উজ্জয়িনী গুপ্ত সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় রাজধানী হয়। অনেকে অবশ্য এলাহাবাদ প্রশস্তির ‘পুষ্পাহবয়’ নগরকে কান্যাকুব্জ বা কৌনজ মনে করেছেন। থেকে সমুদ্রগুপ্তের দ্বিগবিজয় বর্ণরায় ব্যাখ্যা সুষ্ঠু তরভাবে করা সম্ভব। হিউয়েন সাং কুসুমপুর নামে দুটি নম্বরের উল্লেখ করেছেন যার একটি পাটলিপুত্র অন্যটি কান্যাকুব্জ। অর্থাৎ কান্যাকুব্জকেও কুসুমপুর নামে ডাকা হত। সুনীল চট্টোপাধ্যায়ও মনে করেন অচ্যুত, নাগসেন, কোটা পরিবার ইত্যাদির ভৌগোলিক সম্বন্ধের নিরিখে ‘পুষ্পাহবয়’ নগর কান্যাকুব্জ কে বোঝাতে পারে।
এলাহাবাদ প্রশস্তিতে দুবার অচ্যুত ও নাগসেন এর উল্লেখ থাকায় ফাদার ফেরাস মনে করেন সমুদ্রগুপ্ত দুবার আর্যাবর্তে সমরাভিযান চালান। কিন্তু হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে, এই তথ্য মানলে ধরে নিতে হয় অচ্যুত ও নাগসেন প্রথম অভিযানে উন্মুলিত হবার পর দ্বিতীয় অভিযানে প্রচন্ডভাবে উৎখাত হয়েছিলেন। এই ব্যাখ্যার খাতিরে উনুম্ল্য শব্দের পরাজিত এ অর্থের প্রস্তাব সমীচীন মনে হয় না; বস্তুত বুঝিয়ে দেয় যে প্রথম সুযোগেই এদের উৎপাটিত করা হয়েছিল।
সমুদ্রগুপ্তের দিগ্বিজয়ের কারণ ও পরাক্রম বা ভৌগোলিক ক্রমিকতা সম্বন্ধে নানা মুনির নানা মত। কারণ প্রশস্তি থেকে সে বিষয়ে কোন স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। ১৯ থেকে ২২ পংক্তিতে দ্বিগবিজয় বর্ণনা প্রসঙ্গে প্রথমে দক্ষিণাপথের তারপর আর্যাবর্তের তারপর যথাক্রমে আটবিক রাজ্য প্রত্যন্ত নৃপতি ও গণরাজ্য গুলির উল্লেখ হয়েছে বলে মনে করার কারণ নেই যে এই ক্রমেই সমুদ্রগুপ্ত অভিযান করেছিলেন।স্মিথ অবশ্য মনে করেন এই ক্রম মান্য করেই হরিষেন প্রশস্তিতে দ্বিগবিজয় এর বর্ণনা করেছেন তার মত গ্রহণ করা যায় না; কারণ ভৌগোলিকভাবে বহু দূরে দূরে অবস্থিত অঞ্চল এই তালিকায় একই শ্রেণীতে স্থান পেয়েছে। হরিষেন দক্ষিণাপথের রাজাদের নাম গুলি তাদের রাজ্য নাম সহ উল্লেখ করেছেন। রাজাদের নামের ধৃতান্ত বিশ্লেষণ রূপে এ রাজ্য নামগুলি প্রযুক্ত। আর্যাবর্ত রাজগণের মূল ক্ষেত্রে কিন্তু রাজ্য নাম নেই কারণ আর্যাবর্তের রাজাদের রাজ্যগুলি সমুদ্রগুপ্ত নিজের অধিকার নিয়েছেলেন। কিন্তু দক্ষিণাপথের রাজাদের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল ধর্মবিজয় অর্থাৎ সেগুলোকে তিনি করদ রাজ্যে রূপান্তরিত করেন। তাদের পরাজিত করেও রাজ্যগুলি তিনি প্রত্যাহন করেন।
দাক্ষিণাত্যে সমুদ্রগুপ্তের এই ধর্ম বিজয়নীতি আশ্রয় করার কারণ সম্বন্ধে পন্ডিতেরা একমত নন কারো কারো মতে এই নীতি তার অসামান্য রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার প্রমান দেয়। উত্তর ভারতে তার রাজধানী থেকে সুদূর দাক্ষিণাত্যে রাজ্য গুলির উপর নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বজায় রাখা যে অসম্ভব তা তিনি জানতেন। কেউ কেউ মনে করেন সমুদ্রগুপ্তের সেনা কাঞ্চি পর্যন্ত অপ্রতিহত ভাবে দ্বিগবিজয় করতে করতে অভিযান করার পর কাঞ্চির পল্লব রাজা বিষ্ণুগোপের কোন গোষ্ঠীর কাছে পরাজিত হয়, যার ফলে সমুদ্রগুপ্ত বিজিত অঞ্চল নিজের সাম্রাজ্যের যুক্ত করতে ব্যর্থ হন ও এই নীতির আশ্রয় নেন আবার এমন অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে যে এলাহাবাদ প্রশস্তিতে যে ক্রমে পরাজিত রাজাদের উল্লেখ রয়েছে সেটি যদি ঘটনাক্রমকে মান্য করে হয়ে থাকে তাহলে বলতে হয় সমুদ্রগুপ্ত প্রথমে উত্তর ভারতের তিনজন রাজাকে তারপর দাক্ষিণাত্যের রাজাদের ও শেষে আর্যাবর্তের নয় জন রাজাকে পরাজিত করেন। অর্থাৎ উত্তর ভারতে প্রাথমিকভাবে কিঞ্চিত সাফল্যের পর তিনি দক্ষিণ ভারত অভিযান করলে উত্তর ভারতের শত্রুর রাজাদের পুনরায় উত্থান ঘটে ও সমুদ্রগুপ্তকে দাক্ষিণাত্য বিজয় শেষ না করে আর্যাবর্তে ফিরে গিয়ে শত্রুদের উন্মুলিত করতে হয়। আর্যাবর্তে এই রাজনৈতিক সামরিক প্রতিকূল অবস্থায় তাকে বাধ্য করেছিল ওই নীতি অবলম্বনে তবে সমসাময়িক আকরাদী এই ব্যাখ্যার সমর্থনে কোন সাহায্য করে না। দাক্ষিণাত্য অভিযানের সমুদ্রগুপ্ত উড়িষ্যা, অন্ধ্র ও তামিলনাড়ুর পূর্ব উপকূলের অঞ্চলগুলির অধিকারে আগ্রহী ছিলেন। কৃষ্ণা ও গোদাবরীর বদ্বীপও এর মধ্যে ছিল এখানে ছিল বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। সমুদ্রগুপ্ত যে শ্রীলঙ্কা সহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দ্বীপগুলির সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন তা এলাহাবাদ প্রশস্তি আমাদের জানায়। তাই এমনও হতে পারে বন্দরগুলির মাধ্যমে যে বাণিজ্যিক লাভের সম্ভাবনা সমুদ্রগুপ্ত উপলব্ধি করেছিলেন তার বসবর্তী হয়েই তিনি দাক্ষিণাত্য অভিযান করেন। এক্ষেত্রে দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিকে সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ তার না থাকাটা অস্বাভাবিক নয় এছাড়া অনেক পন্ডিত এই নীতির পিছনে অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতাকেও অন্যতম কারণ বলেছেন। গুপ্ত সাম্রাজ্য বিস্তারের মূলে ছিল উৎপাদন ভিত্তিক সম্প্রসারণ অর্থাৎ তখনও যে সব এলাকা অধ্যুষিত হয়নি সেইসব এলাকায় নতুন গ্রাম বস্তি স্থাপন উত্তর মৌর্য যুগের মতো উচ্চ শ্রেণীর ধনী মানুষদের সঞ্চিত সম্পত্তির উপর হামলা করে তা করা হতো না, প্রথম দিকেই গ্রামগুলির সঙ্গে জুড়ে ছিল লোভনীয় বাণিজ্যিক লাভের সম্ভাবনা, গুপ্ত অধিকৃত বঙ্গদেশ ছিল এই ধরনের গ্রাম স্থাপনের পক্ষে আদর্শ স্থান। অধিক দূরত্বের কারণে মৌর্য যুগের মত বল প্রয়োগ করে বসতি স্থাপন সম্ভব ছিল না অপিসকৃত অনধিকৃত জমিও ছিল পর্যাপ্ত। পলি মাটি সমৃদ্ধ উর্বর গাঙ্গেয় উপত্যকা থেকে সহজে খাদ্য সংগ্রহে অভ্যস্ত মানুষদের উৎখাত করে তুলনামূলক অনুর্বর দাক্ষিণাত্যের নিয়ে যাওয়া সহজ ছিল না, তাই দক্ষিণাপথের পরাজিত রাজাদের তাদের নিজ রাজ্যের প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল, অবশ্য তারা কর দিতে স্বীকৃত হওয়ার পরে।
দক্ষিণাপথের যে বারো জন রাজাদের সমুদ্রগুপ্ত পরাজিত করেছিলেন তারা হলেন-
- কোশলের মহেন্দ্র
- মহাকান্তার এর ব্যাঘ্ররাজ
- মদ্র রাজ
- পৃষ্ঠপুরের মহেন্দ্র গিরি
- কোট্টুর রাজা স্বামীদত্ত
- এরান্ডপল্লির রাজা দমন
- কাঞ্চির রাজা বিষ্ণুগোপ
- অবমুক্তের নীলরাজ
- বেঙ্গির রাজা হস্তি বর্মন
- পালক্কর রাজা উগ্রসেন
- দেবরাষ্ট্রের রাজা কুবের ও
- কুস্থলপুরের রাজা ধনঞ্জয়
সমুদ্রগুপ্তের সামরিক নৈপুণ্যের যথাসম্ভব বিশদ উল্লেখ হরিষেন করেছেন। সমুদ্রগুপ্ত বিবিধ প্রকার যুদ্ধে পারদর্শী ছিলেন ও শত শত যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। এইসব যুদ্ধে যে নানা প্রকার অস্ত্রশস্ত্রের আঘাতে তার শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে সুন্দরতর হয়েছিল তাদের অনেকগুলি নাম তিনি করেছেন; যেমন – পরশু, স্বর, শক্তি, প্রাস, অসি, ওমর, বিন্দিপাল, নারাচ ইত্যাদি।
বীর ও দিগ্বিজয়ী সমুদ্রগুপ্তকে যেমন অভিলেখের কবি সযত্নে লিখেছেন তেমনি তার সম্পূর্ণ অন্য একটি সত্তা ও প্রশস্তির নাতিদীর্ঘ পরিসরে আভাসিত হয়েছে। সেখানে তার পরিচয় হল, তিনি কবি, কাব্যতত্ত্বের সূক্ষ্ম রহস্যে অভিজ্ঞ, গুণীজনের পৃষ্ঠপোষ্ শাস্ত্রবেতা, ললিতকলায় পারদর্শী।
সমুদ্রগুপ্তের মানবিক গুণাবলীর বর্ণনাও করেছেন, ক্লান্তিহীন কৃপার্য মানুষের প্রতি এই সম্রাটের হৃদয় ছিল কোমল। ভক্তি ও নতির দ্বারায় তাকে জয় করা যেত। এই অনুকম্পিত রাজা শত সহস্র দান করতেন। দিন অনাথ আতুরের দুঃখমোচনের ব্রত নিয়েছিলেন, মূর্তিমান লোকানুগ্রহ ছিলেন সমুদ্রগুপ্ত শিষ্টের পালন আর দুষ্টের দমন করতেন, সর্বদা অপরাধীর অভ্রান্ত দন্ডবিধান আর ঋতু তুল্য ভয়ংকর ক্রোধের কারণে হয়তো তাকে কুবের বরুণ ইন্দ্র যমের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। নিজ ভুজবলে বিজিত রাজাদের বিভব প্রত্যর্পণের জন্য বহু রাজপুরুষ তার রাজ্যে নিযুক্ত ছিলেন। তার কীর্তি পৃথিবীর সীমা ছাড়িয়ে ইন্দ্র ভবনে গমন করেছিল। সেই কীর্তি উদ্ভাসন করেছেন এই স্তম্ভ এমনই বলা হয়েছে। এই কথাগুলি সংস্কৃত কাব্যের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী অতিরঞ্জন রূপে গ্রাহ্য। এর দ্বারা এই প্রশস্তি সমুদ্রগুপ্তের মৃত্যুর পরে রচিত এমন প্রমাণ হয় না। বিশেষত দ্বিগবিজয় সমাপ্তির পরে সমুদ্রগুপ্ত যে অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছিলেন তার কোন উল্লেখ এতে না থাকায় ফ্লিট এর প্রস্তাবিত এই মরণোত্তর স্তম্ভ প্রতিষ্ঠার যুক্তি নাকচ হয়ে যায়।
প্রশস্তিকার কবি হরিষেনের আত্মপরিচয় টিও যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। তিনি সবিনয়ে জানাচ্ছেন সম্রাটের কাছাকাছি থাকার ফলে তার বুদ্ধির অনুমেলন ঘটেছে। অর্থাৎ পদাধিকার বলে ও সম্রাটের স্নেহভাজন হওয়ার তাকে সমুদ্রগুপ্তের সমীপে বিচরণ করতে হতো তিনি যেসব প্রাথমিক পদ অলংকৃত করেছেন সেগুলি হল – খাদ্যকুটপাকিক, শান্তিবিগ্রহিক, কুমারামাত্য, মহাদণ্ডনায়ক। তার পিতা মহাদন্ডনায়ক ধ্রুবভূতি অর্থাৎ তার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত যোগ্যতা কে যেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তেমনি বিবেচনায় রাখা হয়েছে তার বংশপরম্পরা। প্রাচীন ভারতে অমাত্য নিয়োগের সময় কুল ক্রমাগতির প্রতি অবদান বিরল নয়। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের উদয়গিরি গুহালেখ, প্রথম কুমার গুপ্তের করমদান্ডা অভিলেখ, নারায়ণ পালের বাদাল স্তম্ভলেখ ইত্যাদি এর সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
<-> আরও পড়ুন -> অশোকের শিলালিপি
Important F.A.Q.
১) এলাহাবাদ প্রশস্তি কে রচনা করেন ?
উঃ সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি হরিষেন ।
২) এলাহাবাদ প্রশস্তি কার লেখা ?
উঃ হরিষেনের ।
৩) এলাহাবাদ প্রশস্তি কে কার জন্য রচনা করেন ?
উঃ সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি হরিষেন তার প্রভু সমুদ্রগুপ্তের জন্য এলাহাবাদ প্রশস্তি রচনা করেন।
৪)এলাহাবাদ প্রশস্তির রচয়িতা কে ? / এলাহাবাদ প্রশস্তি কে কার সম্পর্কে রচনা করেন ?
উঃ সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি হরিষেন ।
- এলাহাবাদ প্রশস্তি সম্পর্কে টীকা
- এলাহাবাদ প্রশস্তি pdf