অশোকের শিলালিপি

অশোকের শিলালিপি

ভারতের ইতিহাসে অশোক-ই প্রথম রাজা যিনি তার কার্যকলাপ, আদেশ তথা বাণী লিপিবদ্ধ করে গেছেন। মনে করা হয় তিনি পারস্যের রাজা প্রথম দারিয়াসের রবাতক শিলালিপি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। অশোকের শিলালিপি উৎকীর্ণ করার মূল উদ্দেশ্য ছিল তার বৃহৎ সাম্রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা ও ধর্মের বাণী প্রচার করা।

অশোকের বেশিরভাগ লেখ ব্রাহ্মী অক্ষরে লেখা কিন্তু ভাষা প্রাকৃত। সংস্কৃত ছেড়ে তার প্রাকৃতের ঝোকবার কারণ হল তিনি তার বাণীকে সমাজের সাধারণ শ্রেণীর মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছিল। ১৮৩৭ সালে জেমস প্রিন্সেপ সর্বপ্রথম এই ব্রাহ্মী লিপির পাঠোদ্ধার করেন। তার বেশিরভাগ লেখ ব্রাহ্মীতে হলেও বেশ কিছু লেখ যেমন মানসেরা, শাহবাজগড়ি ইত্যাদি খরোষ্ঠী লিপিতে উৎকীর্ণ করেছেন। গ্রিক অধ্যুষিত অঞ্চলে অশোক গ্লিক ও আরামায়িক ভাষাভাষী লোকজনদের জন্যেও লেখ উৎকীর্ণ করেছেন। আরামিয় ভাষায় উৎকীর্ণ তার লেখ পাওয়া গেছে তক্ষশীলা, কান্দাহার শর-ই-কুনায়। শর–ই-কুনার এই লেখ একখানি দ্বিভাষিক অনুশাসন।

 উৎকীর্ণতার ভিত্তিতে অশোকের লেখমালাকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

১) মুখ্য গিরিশাসন বা মুখ্য প্রস্তর অনুশাসন : 
   অশোকের মুখ্য গিরিশাসনের সংখ্যা ১৪ টি তবে এমন নয় যে এটি ১৪ টি স্থানে পাওয়া গেছে। এটা একটা ভুল ধারণা যে এটি ১৪ টি স্থানে পাওয়া গেছে। এই ১৪ টি অনুশাসন এর অর্থ হলো ১৪ টা অনুশাসন বা আদেশ। এই ১৪ টি অনুশাসন পাওয়া গেছে-

১। আফগানিস্তানের শর-ই-কুনা
২। পাকিস্তানের শাহবাজগড়ি
৩। মানসেরা
৪। হিমাচলপ্রদেশের কালসি
৫। গুজরাতের গিরনার
৬। মহারাষ্ট্রের সোপারা
৭। অন্ধ্রপ্রদেশের এররাগুডি
৮। কর্ণাটকের সন্নতি
৯। ওড়িশার ধৌলি ও
১০। জৌগড়া

তবে এই দশটি স্থানের সবকটিতে ১৪ টি অনুশাসন পাওয়া গেছে এমন নয়। ওড়িশার ধৌলি ও জৌগড় অশোকের একাদশ দ্বাদশ ও ত্রয়দশ অনুশাসনের পরিবর্তে দুটি স্বতন্ত্র অনুশাসন উৎকীর্ণ হয়েছে যা কলিঙ্গ অনুশাসন রূপে বিখ্যাত। মনে করা হয় কলিঙ্গ যুদ্ধের অঞ্চল হিসেবে বিশেষ ভাবে নজর দিতে এই দুটি লেখকে এখানে উৎকীর্ণ করা হয়েছিল। কিন্তু সন্নতি তে এই আলাদা স্বতন্ত্র অনুশাসনের উপস্থিতি এই ধারণা তে সংশয় সৃষ্টি করে। আবার শর-ই-কুনায় প্রাপ্ত শিলালেখে বেশ কিছু অনুশাসন সংক্ষিপ্ত আকারে উৎকীর্ণ হয়েছে। সন্নতিতে প্রাপ্ত শিলাখণ্ডের দুটি পিঠেই লেখ উৎকীর্ণ রয়েছে, একপিঠে অশোকের দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ অনুশাসন এবং অপর পিঠে দুটি স্বতন্ত্র কলিঙ্গ অনুশাসন। আবার এররাগুডি অনুশাসনে গুরুত্বপূর্ণভাবে লক্ষ্য করার মত বিষয়, এই লেখতে অনেক ভুলভ্রান্তি দেখা যায়। এই লেখের অনুশাসনগুলি একটি লাইন বাম থেকে ডান দিকে এবং পরের লাইন ডান থেকে বাম দিকে এরকমভাবে উল্টেপাল্টে রয়েছে মনে করা হয় এই লেখ যারা উৎকীর্ণ করেছিলেন তারা ছিলেন উত্তর-পশ্চিম দিকের আরামায়িক বা খরোষ্ঠী লিপি লিখতে অভ্যস্ত তবে কেন উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের লেখবিদরা এখানে এসে লেখ উৎকীর্ণ করলেন তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

২) গৌণ গিরিশাসন বা গৌণ প্রস্তর অনুশাসন:
   গৌণ গিরিশাসনে উৎকীর্ণ অনুশাসনের সংখ্যা দুটি। প্রথম গৌণ গিরিশাসনটি 17 টি স্থানে শাসন উৎকীর্ণ হয়েছে ও দ্বিতীয় অনুশাসনটি সাতটি থানে উৎকীর্ণ হয়েছে। সর্বমোট ২২ টি স্থানে গৌণ গিরি শাসনের উপস্থিতি মিলেছে। যথা-

১) কান্দাহার
২। লামপাক
৩। বাহাপুর
৪। বৈরাট
৫। ভাবরা
৬। গুজ্জরা
৭। রুপনাথ
৮। রতনপুরবা
৯। পানগুরানা
১০। সৌগড়
১১। সাসারাম
১২। মহাস্থান
১৩। রাজুলা মন্ডগিরি
১৪। জন্নাগিরি
১৫। পালকিগুডু
১৬। গাবিমঠ
১৭। ব্রহ্মগিরি
১৮। জাতিঙ্গা রামেশ্বর
১৯। সিদ্দাপুর
২০। মাস্কি
২১। নিট্টুর
২২। উডেগোলাম

গৌণ প্রস্তর অনুশাসন গুলিতে তারিখের উল্লেখ নেই, তবে মনে করা হয় অশোকের সিংহাসন লাভের 10ম বর্ষে সম্ভবত এগুলি উৎকীর্ণ হয়েছিল। কারণ কান্দাহার অনুশাসনে প্রথম ও দ্বিতীয় অনুশাসনের সংক্ষিপ্ত সার রয়েছে যা ওই সময়কালকে নির্দেশ করে।

৩) মুখ্য স্তম্ভ লেখ :
অশোকের স্তম্ভলেখ মূলত সাতটি, যা আটটি স্থানে পাওয়া গেছে। যথা

১। হরিয়ানার টোপারা
২। উত্তরপ্রদেশের মিরাট
৩। বৈশালী
৪। বিহারের লৌড়িয়া-আররাজ
৫। লৌড়িয়া নন্দনগড়
৬। রামপুরবা
৭। কান্দাহার
৮। রানিঘাট

এই স্তম্ভলেখে অনুশাসন সংখ্যা ছয়টি। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, দিল্লিতে অবস্থিত স্তম্ভ দুটি প্রাথমিকভাবে ওই স্থানে ছিল না। হরিয়ানা টোপরা থেকে এবং উত্তরপ্রদেশের মিরাট থেকে সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক সেগুলিকে দিল্লিতে নিয়ে আসেন। টপারা-দিল্লি স্তম্ভটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শিলালিপির বাহন হয়ে আছে। অশোকের বাকি স্তম্ভ গুলিতে এক থেকে ছয় পর্যন্ত অনুশাসন থাকলেও এই স্তম্ভে সপ্তম অনুশাসন ঘোষিত হয়েছে, এমনটি আর কোথাও আবিষ্কৃত হয়নি। এই শিলালিপি সম্ভবত অশোকের একেবারে শেষ পর্যায়ের রচনা।

৪) গৌণ স্তম্ভলেখ :
অশোকের গৌণ স্তম্ভলেখ সর্বমোট ছয়টি। এগুলি পাওয়া গেছে ছটি স্থানে যথা-

১। উত্তরপ্রদেশের সারনাথ
২। কৌশাম্বি
৩। এলাহাবাদ
৪। মধ্যপ্রদেশের সাঁচী
৫। নেপালের লুম্বিনী
৬। নিগলিন

অশোক তার রাজত্বের কুড়িতম বর্ষে বুদ্ধের জন্মস্থান লুম্বিনী গ্রামে ভ্রমণ করেন যার স্মারক রূপে সেখানে তিনি একটি স্তম্ভ স্থাপন করেন এবং সেখানে করের পরিমাণ ৮ ভাগের এক ভাগ করে দেন। ওই একই বছরে পার্শ্ববর্তী নিগালিসাগরও ভ্রমণ করে স্তম্ভগাত্রে তার বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন।
লুম্বিনি সম্পর্কে একটি মজার কথা প্রচলিত আছে, লুম্বিনির স্তম্ভটির সত্যতা সম্পর্কে অনেকে বিরোধিতা

অশোকের শিলালিপি
লুম্বিনি স্তম্ভলেখ

করেছেন। বলা হয় তিনি যিনি এই স্তম্ভটি উৎখনন করেছিলেন তিনি ছিলেন পুরাতন সামগ্রীর দালাল। ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ তার বিরোধিতা করেন। এই স্তম্ভর সত্যতাতে সংশয়ের বেশ কিছু কারণ তারা দেখিয়েছেন। প্রথমত হিউয়েন সাং বুদ্ধের জন্মস্থান খোঁজার সময় স্তম্ভের উল্লেখ করেছেন তবে তাতে কোন লেখার উল্লেখ করেননি। দ্বিতীয়ত লেখটি তৃতীয় পুরুষে লেখা এবং এর অক্ষরগুলি সমকালীন লিখিত ব্রাহ্মী অক্ষরের তুলনায় অক্ষত ও সুন্দর। চতুর্থত বুদ্ধকে প্রাকৃতে ‘সাকেমুনি’ ‘সাকামুনি’ বলা হলেও এখানে সংস্কৃতের অধিক্রমনে তাকে ‘সাক্যমুনি’ বলা হয়েছে। এ থেকে অনুমান করা হয় তিনশ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে খ্রিষ্টাব্দ প্রথম শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে এ স্তম্ভের লেকটি উৎকীর্ণ করা হয়েছে। হিউয়েন সাং এর বর্ণনা অনুসারে স্তম্ভের মাথায় একটি ঘোড়ার মূর্তিও ছিল যা কালের গহ্বরে আজ ক্ষয়প্রাপ্ত।

৫) গুহা লেখ :
অশোকের লেখগুলির মধ্যে গুহালেখ গুলি ব্যতিক্রমী। তার বাকি লেখগুলি যেখানে ধর্ম, শান্তি-শৃঙ্খলা, শাসন ইত্যাদি বিষয়ের প্রতিনিধিত্ব করে সেখানে তার এই গুহালেখ গুলি দানের প্রতিভূ স্বরূপ। গুহালেখ গুলি মহৎ উদ্দেশ্যে আজীবনদের দান করা হয়েছিল দান এমনটি বলা হয়। বিহারের বরাবর পাহাড়েই একমাত্র এই তিনটে গুহালেখ পাওয়া যায়। পাহাড়ের তিনটি গুহার প্রতিটিতেই আলাদা আলাদা করে দান উত্তীর্ণ রয়েছে। ঋষিঝোপড়ি গুহাতে বলা হয় অশোকের রাজ্যাভিষেকের দ্বাদশ বছর পরে এই গুহা আজীবকদের উদ্দেশ্যে দান করা হয়েছিল।
 অশোকের শিলালিপি
ঋষিঝোপড়ি গুহালেখ, বরাবর পাহাড়
 শিলালিপিতে অশোক:
   অশোক তার লেখমালায় বারবার নিজেকে “দেবানম পিয় পিয়দসি” (দেবানমপ্রিয় প্রিয়দর্শী) বলে পরিচয় দিয়েছেন। প্রথমে প্রিয়দর্শী এই রাজাকে শনাক্ত করা না গেলেও পরবর্তীতে মাস্কিতে প্রাপ্ত গৌণ প্রস্তর অনুশাসনে রাজা অশোক বলে নিজেকে পরিচয় দিয়েছেন। তিনি নিজেকে অশোক বলে পরিচয় দিয়েছেন মাত্র চারটি গৌণ গিরিশাসনে, যথা- মাস্কি, গুজরা, নিট্টুর ও উডেগোলাম। ‘দেবানমপিয়’ কথার অর্থে অশোক নিজেকে দেবতাদের প্রিয় বলে ব্যক্ত করেছেন। ‘প্রিয়দর্শী’ কথার অর্থ হল সকলকে প্রিয়রূপে যে দর্শন করে। অন্যের মঙ্গল কামনা করেন যিনি তিনিও প্রিয়দর্শী। তবে মনে রাখতে হবে ‘দেবানম প্রিয় ও প্রিয়দর্শী’ অশোকের নাম নয়, উপাধি।

অশোক যে দারিয়াসের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে শিলালিপি খোদিত করে প্রচার করার চেষ্টা করে গেছেন তা আগেই বলা হয়েছে। তবে দারিয়াস ও অশোকের উদ্দেশ্য একটা গুরুতরূপ ভিন্নতা ছিল। সামাজিক সাফল্য, প্রভূত শক্তি, শাস্তি দানের ক্ষমত্ একছত্র আধিপত্য ছিল দারিয়াসের শিলালিপির আলোচ্য বিষয়; কিন্তু অশোক একেবারে ভিন্ন এক বার্তার প্রস্তাবনা করেছেন। সে তার ধর্মের কথা ক্ষুদ্র থেকে মহৎ মানুষ, এককথায় সাম্রাজ্যের সকল জনসমষ্টির কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন। সাম্রাজ্যে শান্তি ও সৌভ্রাতৃত্বের বাণী তিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। যদিও এর ভাষা সহজ সরল সাধারণ মানুষের কথ্য ভাষা ছিল তবুও এই রাজকীয় শিলালিপির ভাষা বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের তা বোধগম্য হয়েছিল কিনা তাতে সন্দেহ থেকে যায়।
এতসব সীমাবদ্ধতা সত্বেও নিজের কথাকে পাথরে উৎকীর্ণ করার জন্য অশোকের যে ব্যাকুলতা ছিল তার অন্তরে এর দুটি গোপন উদ্দেশ্য লুকিয়ে ছিল। একটি হলো তার ভাবনাকে কালের প্রকোপ থেকে বাঁচিয়ে দীর্ঘমেয়াদি করে তোলা যাতে তার উত্তরাধিকারী প্রজন্ম পরম্পরায় এই বাণী প্রচলিত থাকে যা পঞ্চম ও ষষ্ঠ প্রস্তর অনুশাসনেও অসুখ উল্লেখ করেছেন। দ্বিতীয়টি হল, তার আধিকারিকগণ তার বহুবিস্তৃত মৌখিক অভিভাষনে প্রজাবৃন্দকে বার্তা জানাতে চান তার আদর্শ অনুস্মারক হয়ে ওঠায় এর কাজ। অশোকের অনুশাসনের বর্তমান পাঠোদ্ধারে তার সেই দীর্ঘ কালাবর্তনে বেঁচে থাকার ইচ্ছাকে পূরণ করে দিয়েছে। অতএব কালের অক্ষরে পাথরের গায়ে নিজের কথা রেখে যাওয়ার জন্য তার যে অনন্ত প্রচেষ্টা সেটি তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে কোনভাবেই ব্যর্থ হয়নি।

শিলালিপির চার্ট ডাউনলোড করুন ->

PDF

F.A.Q : –

১) অশোকের শিলালিপি কে কবে পাঠোদ্ধার করেন ?

উঃ ১৮৩৭ সালে জেমস প্রিন্সেপ সর্বপ্রথমপাঠোদ্ধার করেন।

২) অশোকের শিলালিপি কোন লিপিতে লেখা ?

উঃ ব্রাহ্মী

৩) অশোকের শিলালিপি কোন ভাষায় লিখিত ?

উঃ প্রাকৃত

৪) কোন শিলালিপি থেকে অশোকের নাম জানা যায় ?

উঃ কর্ণাটকের মাস্কি শিলালিপি থেকে। এটি গৌণ গিরিশাসন ।

৫) কোন সম্রাট অশোক স্তম্ভ কে দিল্লি নিয়ে এসেছিলেন ?

উঃ ফিরোজ শাহ তুঘলক

৬) অশোক স্তম্ভ টি কোথায় পাওয়া গেছে ?

উঃ সারনাথে

…আরও পড়ুন : মুঘল চিত্রকলা

Leave a Comment