জায়গীরদারি প্রথার সংকট

জায়গীরদারি প্রথার সংকটঃ

জায়গীর কি ?

  • মুঘল আমলে যে ভূমি বন্দোবস্ত গুলি প্রচলিত ছিল তার মধ্যে জায়গীর ব্যবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। মূলত কোন রাজকর্মচারী বা অভিজাতকে নগদ বেতনের পরিবর্তে যে জমি দেওয়া হতো তাকে বলা হয় জায়গীর এবং যাদের দেওয়া হতো তাদের বলা হতো জায়গীরদার

জায়গীরদাররা এই সকল জমিতে খাজনা আদায় করার অধিকার থাকলেও জমির উপর তাদের কোন অধিকার ছিল না। রাষ্ট্রের অধিকৃত কিছু জমি থাকত যাকে বলা হত ‘খালিসা’। এই খালিসা গুলি পরবর্তীতেজায়গীরদারি প্রথার সংকট বেতনের পরিবর্তে বিলি করা হতে থাকে। এতে এক দিক দিয়ে যেমন রাষ্ট্র কর্তৃক নগদ বেতন দিতে হতো না, তেমনি অনাবাদি খালিসা জমি গুলি আবাদি জমিতে রূপান্তরিত হতো। এর ফলে রাষ্ট্র দুই দিক দিয়ে লাভবান হত। জায়গীরদারদের যে এলাকা দেয়া হতো তাতে কি পরিমান খাজনা আদায় করা হবে তা আগে থেকেই নির্ধারণ করা হতো যাকে বলা হয় জমা। কোন যুবরাজ এই জায়গির পেলে তাকে বলা হয় তুইয়ুল

  • কেন দেখা দিল সংকট?

১)জটিল কেন্দ্রীয় সমস্যাঃ বরের আমলে এই জায়গার ব্যবস্থা ও মনসবদারি ব্যবস্থা প্রায় মিলেমিশে যায়। আকবর তার রাজত্বকালে প্রথম দিকে জায়গীরদারদের নগদে অর্থ দেওয়া চালু করেন। পরবর্তীতে আবার তা তুলে দিয়ে পুনরায় আগের জায়গীর প্রথা বজায় রাখেন। ক্রমাগত বদলের ফলে জায়গীরদারি প্রথা অনেক বেশি জটিল হয়ে পড়েছিল। যা জায়গীরদারি ব্যবস্থাকে সংকটের মুখে ফেলে দেয়। প্রথমত জমিগুলোতে সরকার ও জায়গীরদারের উভয়ের কর্তৃত্ব রয়েছে, দ্বিতীয়তঃ কেন্দ্রীয় দেওয়ান জমির খাজনা খাজনার হার নির্ধারণ করতেন যার ফলে প্রায়শই আদায়কৃত রাজস্ব বা জমাতে ঘাটতি দেখা দিত। সুতরাং জায়গীরদারদের দুটি মূল সমস্যা ছিল, একটি হচ্ছে কেন্দ্রীয় বিভাগের নিয়ন্ত্রণ অর্থাৎ সরকারের নিয়ম কারণ মেনে চলার সমস্যা; দ্বিতীয়টি ছিল তাদের জায়গির নিয়ন্ত্রণ করার সমস্যা।

২)খালিসা জমির ভাঙনঃ সম্রাট শাহজাহানের সময় থেকেই জায়গীর বন্টনকে কেন্দ্র করে জমির অভাব ও সংকট দেখা দিতে থাকে। ওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে জায়গীর ছিল সাম্রাজ্যের প্রধান অংশ। কিন্তু তার মৃত্যুর পর তা পরিবর্তন হয়। দেখা যায় বহুদিন ধরে একটা জায়গীর একটি লোকের হাতে থাকতে থাকতে তা বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকারে পরিণত হয়। নাদির শাহের আক্রমণের পর জায়গীর নির্ভর করে জায়গীরদারদের সামরিক শক্তির উপর এবং এদের মধ্যেই ছোট ছোট রাজ্য গড়ে উড়তে থাকে। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর আগেই জায়গীরদারিতে সংকট শুরু হয়ে যায় দাক্ষিণাত্যে থাকাকালীন ঔরঙ্গজেব বহু সংখ্যক মনসবদার নিয়োগ করার ফলে জায়গীর এর উপর চাপ বাড়তে থাকে। পুরনো মনসবদার ও নতুন মনসবদারের মধ্যে লড়াই ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। এর ফলে নতুন নিয়োগ হতে থাকে নগদ টাকার ভিত্তিতে, যার ফলে যে জায়গীর দেওয়া হত নগদ টাকার পরিবর্তে তা নগদ টাকার ভিত্তিতে হয়ে ওঠে। অর্থাৎ জায়গীরদারী ব্যবস্থা তার চরিত্র হারায়।

৩)কৃষকের উপর চাপ বৃদ্ধিঃ জায়গীর দেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেলে জায়গীর এর উপর চাপ বাড়তে থাকে। ফলস্বরূপ পূর্বের জায়গির গুলিকে ছোট ছোট অংশে বিভক্ত করে বেশি সংখ্যক জায়গীরদারদের মধ্যে বিলি করা সম্ভব হয়। ফলত  প্রত্যেকের অধীনে জমির পরিমাণ কমে যায় যার ফলে প্রতিটি জায়গিরদার কম পরিমাণ জমি থেকে বেশি কর আদায়ের লক্ষ্যে খাজনা বাড়াতে থাকে ও কৃষকদের উপর অত্যাচার শুরু করে। কৃষকদের উপর অত্যাধিক রাজস্বের চাপ বৃদ্ধি পেলে বহু কৃষক আত্মরক্ষার জন্য জমি ছেড়ে বনাঞ্চলে পালিয়ে পালিয়ে যেত। এতে যেমন কৃষকদের অবস্থা সংকটের মুখে পড়েছিল তেমনি তা মোগল সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক সংকটকেও ত্বরান্বিত করেছে। পাশাপাশি কৃষকদের মনে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতি ক্ষোভ জমতে থাকে তাই ঐতিহাসিক ইরফান হাবিব এই সংকটকে মুঘল সাম্রাজ্যের কৃষি প্রথার সংকট বলে অভিহিত করেছেন।

৪)জমির সংকটঃ আতাহার আলীর মতে, ওরঙ্গজেবের রাজত্বকালের শেষের দিকে এই সংকট প্রকট হয়ে ওঠে। দাক্ষিণাত্যের যুদ্ধ চলাকালীন আর্থিক অবস্থার উপর চাপ সৃষ্টি হয়। সম্রাট উত্তর ভারত থেকে দক্ষিণ ভারতের চলে গেলে শাসনতন্ত্র এলোমেলো হয়ে পড়ে। দাক্ষিণাত্যে একের পর এক খালিসা জমি বিলির ফলে শেষের দিকে  বিলি করার মত আর কোন জায়গির বাকি থাকে না। জায়গীর প্রথা জটিল হতে থাকে এবং সম্রাটের আদেশ বারবার লঙ্ঘিত হয়। ফলে ছোট ছোট মনসবদারদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে।

মুল্যায়নঃ অবশেষে দীর্ঘ তিন শতাব্দী ধরে চলতে থাকা জায়গীর প্রথা এভাবে ক্রমশ জটিল বিবর্তনের সাথে সংকটের মুখে পতিত হয়। জায়গিরদারি সংকটের ফলশ্রুতিতে বহু কৃষক ভূমি হারা হয়। এই প্রথম কৃষকদের জমিতে চাষ করানোর জন্য নির্যাতন করা হতে থাকে। কৃষকরা যাতে পালিয়ে না যায় তার জন্য জায়গীরদার রা ‘হকেয়া’ প্রথা চালু করে এই প্রথা অনুযায়ী পালানো চাষীকে ফিরিয়ে এনে চাবুক মারা হত। মার ধরের সাথে চলত লুন্ঠন ও নানা অমানুষিক অত্যাচার। কখনো কখনো তাদের স্ত্রী-পুত্রকে ক্রীতদাস হিসেবে বাজারে বিক্রিও করা হত। এই সকল অমানুষিক অত্যাচারের ফলে কৃষকরা বহু ক্ষেত্রে বিদ্রোহ করে ওঠে, অনেক ঐতিহাসিকের মতে যা ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের একটি ধাপের সূচনা।

PDF

Leave a Comment