আলাউদ্দিন খলজির বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা

আলাউদ্দিন খলজির বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা

ভূমিকা : আলাউদ্দিন খলজির অর্থনীতি সংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল আলাউদ্দিন খলজির বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা যার দ্বারা তিনি নিত্য প্রয়োজনীয় সব জিনিসের বাজারদর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছিলেন। জিয়াউদ্দিন বরনির লেখা দুটি গ্রন্থ তারিখ-ই-ফিরোজশাহী এবং ফুতুহ-ই-জাহান্দেরি থেকে এই ব্যবস্থার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। সুফি সন্ত নাসিরউদ্দিন চিরাগের খয়রুল-মুজলিস এর বিবরণীতে এর বিশেষ উল্লেখ রয়েছে। তবে আধুনিক ঐতিহাসিকরা বর্ণির দেওয়া বিবরণীকেই বেশি নির্ভরযোগ্য মনে করেন।

*কারণ সমূহ*

১) সেনাবাহিনির ভরন পোষণ : বরনি তার তারিখ-ই-ফিরোজশাহী গ্রন্থে লিখেছেন যে মঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করা এবং সাম্রাজ্যবাদী ও চক্রান্তকে চরিতার্থ করার জন্য আলাউদ্দিন চার লক্ষ ৭৫ হাজার সেনার এক বাহিনী গড়ে তোলেন। ফেরিস্তাও এই একই সংখ্যক সেনাবাহিনীর কথা বলেছেন। এই বিশাল সংখ্যক সেনাবাহিনীর ভরণপোষণের জন্য সুলতান কে ভারতীয় অর্থের সন্ধান করতে হয়। সেনাদের বার্ষিক বেতন বাড়ানো হলেও বাজারদরের সঙ্গে তো সংহতিপূর্ণ ছিল না। সেনাবাহিনী ছিল রাজকোষ থেকে প্রদেয় বেতনের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু বেতনের অর্থ মূলত নির্ভর করে দ্রব্যমূলের স্থিতিশীলতার উপর। বর্ণী জানিয়েছেন দ্রব্যমূল্যের নিম্নহার বজায় রাখতে না পারলে জনসাধারণের সুখ সমৃদ্ধি সম্ভব নয়। তার মতে এই সমস্ত কারণে সুলতান দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবস্থা নেন।

২) প্রাসাদ তৈরি ও সেনার বেতন হ্রাস : ফিরিস্তার মতে আলাউদ্দিন বেশ কয়েকটি ব্যয়বহুল প্রাসাদ তৈরি করেন। এই সকল কারণে বিশাল পরিমাণ অর্থের দরকার হয়। যদিও তিনি ভূমি রাজস্বের হার বাড়ান এবং দেবগিরি থেকে বহু ধরনের সম্পদ লুঠ করেন। তবুও হিসাব করে দেখা যায় যে ৫-৬ বছরের মধ্যে বাড়তি খরচ মেটাতে এসব অর্থ খরচ হয়ে যাবে। এমতাবস্থায় তিনি বিশ্বাসভাজন মন্ত্রীদের পরামর্শ গ্রহণ করেন, তারা পরামর্শ দেন যে যদি আলাউদ্দিন বেতন না বাড়িয়ে জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন তবে তার সরকারের বর্তমান আয় অনুসারে সেনা দলের প্রতি সেনাকে বছর ২৩৪ তঙ্কা হারে বেতন দিলেই চলবে। জিনিসপত্রের দাম কম থাকলে এই টাকায় সেনাদল তাদের জীবনযাত্রার বাহিনী নির্বাহ করতে পারবে।

3) হিন্দুদের শায়েস্তা : ঐতিহাসিক বরনি আবার মন্তব্য করেছেন যে, আলাউদ্দিন বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুদের শায়েস্তা করা কারণ সে আমলে ব্যবসা-বাণিজ্য হিন্দুদের প্রাধান্য ছিল। অধ্যাপক সতীশচন্দ্রের বক্তব্যের বিরোধিতা করে লিখেছেন এ সময় ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রধান অংশ নিয়ন্ত্রণ করতে সুলতানি এর মুলতানি ও খোরাসানী বণিকরা বাজারদর নিয়ন্ত্রণ নীতির শৃঙ্খলে এরাও আবদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন।

৪) জনগনের কল্যান : আবার সুফি নাসিরুদ্দিন চিরাগ আলাউদ্দিনের মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতির এক অন্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি দিল্লির কাজে আবেগের সঙ্গে সুলতানের এক কর্তব্যের কথা উধৃত করে জানিয়েছেন যে, সুলতান বিশ্বাস করতেন জীবজগতের কল্যাণ সাধনে তিনি সর্বশক্তিমান কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত। সুলতানের কাছে জনসাধারণ হলো খালোক-ই-খুদাই। জনসাধারণের স্বার্থ রক্ষা তার ব্রত ছিল। তিনি মনে করতেন যে ন্যায্য মূল্যে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জনসাধারণকে সরবরাহ করতে পারলে তার নৈতিক কর্তব্য পালন করা হবে। এই উদ্দেশ্য পূরণের জন্যই তিনি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতি চালু করেন।

আমির খসরু তার খাজাইন-উল-ফুতুহ গ্রন্থে জানিয়েছেন যে আলাউদ্দিন একজন জাহাঙ্গীর অর্থাৎ রাজ্য বিজেতা হওয়ার থেকেও একজন জাহান্দার বা দক্ষ প্রশাসক হতে চেয়েছিলেন। আল্লাহর সন্তানদের প্রতি সুলতানের ভালোবাসা চাঁদ বা নক্ষত্রের প্রতি সূর্যের ভালোবাসার থেকেও বেশি ছিল। তাই সুলতান নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেঁধে দেন।

৫) মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রন : আধুনিক কালে ডঃ ইউএন দে আলাউদ্দিনের দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতির পেছনে অন্য কারণে কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন আলোচ্য সময়ে দিল্লী ছিল সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র সেখানে বিশাল সংখ্যক সেনাবাহিনীর উপস্থিতি ছাড়াও অসংখ্য মানুষের যাতায়াত ছিল। এর ফলে দিল্লির লোক সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। লোকসংখ্যা বৃদ্ধির উপজাত ফসল হিসাবে দিল্লিতে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। একজন যথার্থ রাষ্ট্রনায়কের মতো সুলতান এই মুদ্রাস্ফীতি রোধ করা সহ সাধারণ মানুষের জন্য খাদ্যশস্যের যোগান অব্যাহত রাখতেই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতি চালু করেন।

৬) খাদ্যশস্যের অসম বণ্টন : ডক্টর এসকে লাল বলেছেন আলাউদ্দিনের রাজত্বকাল ছিল যুদ্ধবিগ্রহের পরিপূর্ণ। যুদ্ধবিগ্রহের জন্য পণ্য চলাচল ও সরবরাহ ব্যবস্থা খুবই বিপর্যস্ত হতো। ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে মালিক তারঘি যমুনাপার হয়ে দিল্লি আক্রমণ করলে দিল্লিতে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়। এর ফলে শহরে যে সকল বণিকের গুদামে খাদ্যশস্য মজুদ থাকতো, তারা অনেক বেশি ধরে খাদ্যশস্য বিক্রি করতো। ভবিষ্যতে রাজধানীতে যাতে এরকম অবস্থার উদ্ভব না হয় এবং বাজারের দরের স্বাভাবিক হার বজায় থাকে এই উদ্দেশ্যে আলাউদ্দিন মূল্য নিয়ন্ত্রণ করেন। এজন্য তিনি সরকারি গুদামে খাদ্যশস্য মজুদ নিয়মিত পরিমাণে খাদ্যশস্য ক্রয়ের ব্যবস্থা এবং নিয়মিত নিয়ন্ত্রিত দরে দ্রব্যস বিক্রয়ের ব্যবস্থা করেন।

সুতরাং এই সিদ্ধান্ত উপনীত হওয়া যায় যে সামরিক প্রয়োজন এবং মধ্যের স্মৃতিজনিত মূল্য বৃদ্ধি বন্ধ করার জন্য আলাউদ্দিন উৎপাদন মূল্যের সঙ্গে সংঞ্জস্য রেখে মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতি চালু করেন। তার মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতি তিনটি নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল যথা- ১) সৈন্য ও কর্মচারীদের 234 তঙ্কা হারে নির্দিষ্ট বেতন প্রদান, ২) দ্রব্যমূল্যের নির্ধারিত মূল্য তালিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা, ৩) নিয়মিতভাবে নির্ধারিত মূল্যে খাদ্যদ্রব্যের যোগান দেওয়া। বেশিরভাগ আধুনিক ঐতিহাসিকই এই মতকে সমর্থন করেছেন ।

আলাউদ্দিন খলজির বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা

*নির্দেশনামা জারি*

অতঃপর শস্য বাজার পরিচালনা শস্য সরবরাহ অবৈধ লেনদেন বন্ধ করা পরিবহন সুনিশ্চিত করা ইত্যাদির জন্য একাধিক নির্দেশ নামা জারি করা হয়।

 প্রথম নির্দেশ নামা : আলাউদ্দিন তার প্রথম নির্দেশ নামায় এক বিস্তৃত মূল্য তালিকা প্রকাশ করেন। তবে এই মূল্য তালিকা প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে ভিত্তি কি ছিল তা জানা যায় না। ঐতিহাসিকেরা মনে করেন যে সুলতানের জীবিত কালে এই মূল্য তালিকার কোন পরিবর্তন ঘটেনি। মূল্য তালিকাটি হল-

দ্রব্যমুল্য
১) গম প্রতি মন ১/২ জিতল
২) বার্লি প্রতি মন৪ জিতল
৩) চাল প্রতি মন৫ জিতল
৪)  সিম মটর প্রতি মন২ জিতল
৫) লবণ প্রতি মন২ জিতল
৬) তিনি প্রতি শের১/২ জিতল
৭) মাখন প্রতি আড়াই শের১ জিতল
৮) একজন সাধারন দাসী৫-১২ তঙ্কা
৯) একজন সাধারন দাস১০-১৫ তঙ্কা
১০) একজন সুন্দরী দাসী১০০-১৫০ তঙ্কা
১১) একজন শক্তিশালী দাস৪০-১৬০ তঙ্কা
১২) একটি সাধারণ মধ্যম    নিকৃষ্ট আরবি ঘোড়া৮০-৯০ তঙ্কা
১৩) একটি উৎকৃষ্ট আরবি করা১০০-১২০ তঙ্কা
১৪) একটি ভারতীয় টাট্টু ঘোড়া১০-২৫ তঙ্কা

দ্বিতীয় নির্দেশনামা :  আলাউদ্দিন তার দ্বিতীয় নির্দেশ নামা দ্বারা শস্য সংগ্রহ ও এই ব্যবস্থার নীতি নিয়মের কথা বলেন। প্রধান শস্য বাজার ছিল মান্ডি। শস্য বাজারের প্রধান ছিল প্রধান নিয়ন্ত্রক শাহানা ই মান্ডি। শাহানা ই মান্ডি হিসাবে আলাউদ্দিনের বিশ্বস্ত ও দক্ষ কর্মচারী মালিক কাবুল কে নিয়োগ করা হয়। পদমর্যাদা অনুযায়ী তাকে ইক্তা প্রদান করা হয় এবং তার পছন্দমত একজন সহকারি নিয়োগ করার ব্যবস্থা রাখা হয়। বাজারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং অসৎ ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য শাহানা ই মান্ডি এর অধীনে অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্য রাখা হয়। আলাউদ্দিন মান্ডির কাজকর্ম সম্পর্কে নিয়মিত খবর জানার জন্য বারদী ও মুন্সী নামক গুপ্তচর নিয়োগ করেন।

দ্বিতীয় নির্দেশ নামাতেই সুলতানের আদেশে আরো কয়েকটি স্বতন্ত্র বাজার ও আধিকারিকের পদ সৃষ্টি হয়। বাজারগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বস্ত্র চিনি ঘি মাখন শুকনো ফল জ্বালানি তেল প্রভৃতি ক্রয় বিক্রয়ের জন্য সেরা এই আদল বা ন্যায় ভবন নামক সাধারণ বাজার। সেরা-ই আদল এর সঙ্গে যুক্ত বণিকদের নাম দেওয়ান-ই রিয়াস নামক এক স্বতন্ত্র দপ্তরে নথিভুক্ত করতে হতো। এক্ষেত্রে তাদের অঙ্গিকার করতে হতো যে তারা সেরা এই আদলে নিয়মিত ও নির্দিষ্ট মূল্যে দ্রব্য সরবরাহ ও বিক্রয় করবে। অন্যদিকে মান্ডি ও সেরা এই আদল ছাড়াও বিলাসবহুল দ্রব্যাদি ঘোড়া ও গবাদি পশুর বিক্রয়ের জন্য সুলতান দুটি আলাদা বাজার স্থাপন করেন।

তৃতীয় নির্দেশনামা : আলাউদ্দিন তার তৃতীয় নির্দেশ নামার মাধ্যমে জানান যে কোন কোন এলাকার কৃষক শস্যের দ্বারা রাজস্ব মেটাবে এবং কোন কোন অঞ্চলের কৃষক নগদের রাজস্ব প্রদান করবে। এই নির্দেশ নামাতে বলা হয় যে, রাজস্বের যাবতীয় শস্য সুলতানের শস্য ভান্ডারে মজুদ করা হবে।

চতুর্থ নির্দেশনামা : চতুর্থ নির্দেশনামায় দিল্লির পণ্য সরবরাহকারীদের যমুনার তীরে বসবাস করার আদেশ দেওয়া হয়। সুলতানের উদ্দেশ্য ছিল বাজারগুলোতে যাতে অন্য সরবরাহে বিঘ্ন না ঘটে।

পঞ্চম নির্দেশনামা : সুলতানের পঞ্চম নির্দেশ নামায় ঘোষণা করা হয়েছে কোন কোন পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীকে কি ধরনের শাস্তি দেওয়া হবে। দেওয়ান ই রিয়াসদ দপ্তরটির কাজ ছিল কোন ব্যবসায়ী কোন পন্যের ওজন কম  দিলে তার দ্বিগুণ ওজনের মাংস শরীর থেকে কেটে নেওয়া। কোন দ্রব্যের দাম দেড় জিতল বেশি নিলেও বিক্রেতার কঠোর শাস্তি সহ পণ্য বাজেয়াপ্ত করা হতো। সবচেয়ে বড় কথা হলো খাদ্যশস্যের অপচয় বন্ধ করতে সুলতানি শাসকদের মধ্যে আলাউদ্দিন খলজী প্রথম রেশনিং ব্যবস্থা চালু করেন। মোরল্যান্ড বলেছেন রেশন ব্যবস্থার ফলে দিল্লি বা আশেপাশে দীর্ঘকাল দুর্ভিক্ষ বা খাদ্যাভাব দেখা দেয়নি।

ষষ্ঠ নির্দেশনামা : সুলতান তার ষষ্ঠ নির্দেশ নামায় তার প্রশাসন ও রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীদের জানিয়ে দেন যে উৎপন্ন শস্য নিজেদের খামারে তোলার আগেই যেন শস্য ব্যবসায়ীরা কৃষকদের কাছ থেকে সেই শস্য কিনে নিতে পারে।

সপ্তম নির্দেশনামা : সপ্তম নির্দেশনামায় সাহানা ই মান্ডি , বারিদ বা মুন্সী প্রভৃতির মাধ্যমে তার নির্দেশাবলী ঠিকমতো কার্যকর হচ্ছে কিনা তা প্রত্যাহ খোঁজখবর নিতেন।

*বিতর্ক*

আলাউদ্দিন খলজির বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পর্কে ঐতিহাসিক মহল একটি বিতর্ক আছে বিষয়টি হলো এই যে মূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কি কেবলমাত্র দিল্লি শহরে বলবৎ ছিল নাকি এটি দেশের সর্বত্র চালু ছিল। বর্ণির বক্তব্যের মধ্যে স্ববিরোধিতা লক্ষ্য করা যায়। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন যে এটি কেবল দিল্লিতে বলবত ছিল এবং মূলত সেনাবাহিনীর প্রয়োজনে এই ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল; আবার অন্য গ্রন্থটিতে তিনি লিখেছেন যে, যেহেতু দিল্লিতে আলাউদ্দিনের প্রধান সেনাদল ছিল দিল্লিতে সেহেতু আলাউদ্দিন দিল্লিকে দেশের অপরাপর অঞ্চল থেকে আলাদা করে দেখতেন ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ একমাত্র সেখানেই চালু করেন। বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রশ্ন তুলেছেন যে সেনাবাহিনী সংগ্রহ করা হতো সারা দেশ থেকে, কেবল দিল্লিতে মূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু থাকলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা সেনা পরিবার গুলি কিভাবে উপকৃত হতো? ফেরেস্তার বিবরণ থেকে মনে হয় যে মূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সারা দেশে প্রযোজ্য ছিল। ডাক্তার নিজামি ফেরেশতার বিবরণীকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন। কিন্তু ডক্টর পি চরণ ও কে এস লাল এর বিরোধিতা করেছেন। অধ্যাপক সতীশচন্দ্র অবশ্য বলেছেন তথ্যের অভাবে এ বিষয়ে নিশ্চিত কিছু বলা সম্ভব নয়।

আধুনিককালে অধ্যাপক কে এস লাল বিষয়টিকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখেছেন তিনি মন্তব্য করেছেন যে সুফি সন্ত নাসিরউদ্দিন চিরাগের ব্যাখ্যা নির্ভরযোগ্য নয়। প্রথমত এই রচনা আলাউদ্দিনের মৃত্যুর ৫০ বছর পরে লেখা হয় এবং শোনা কথার উপর নির্ভর করেই এটি রচিত। দ্বিতীয়ত অন্য কোন সমকালীন লেখক সুফি ব্যাখ্যা কে সমর্থন করে মতামত ব্যক্ত করেননি। দ্বিতীয়ত একমাত্র নির্ভরযোগ্য সমকালীন লেখক বর্ণী দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতির সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আলাউদ্দিনকে সন্তুষ্ট করার জন্য তিনি তার রচনা লিপিবদ্ধ করেন। আলাউদ্দিনের দরবারে পাঠের উদ্দেশ্যে তা রচিত হয় আর আমির খসরু আলাউদ্দিনের দরবারে সাহিত্যিক ছিলেন। তিনি খুব নিরপেক্ষ লেখক ছিলেন বলে অনেকে মনে করেন না।

*ফলাফল*

আলাউদ্দিন খলজির মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতির ফলাফল সম্পর্কে ঐতিহাসিক মহলে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। সমকালীন লেখক ফিরিশতা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছেন যে সুলতানের এই পদক্ষেপ ছিল একাধারে বিস্ময়কর ও উল্লেখযোগ্য। তিনি মন্তব্য করেছেন এ জিনিস আগেও দেখা যায়নি। পরেও সম্ভব হতো কিনা বলা যায় না। অন্যদিকে ডাক্তার পি স্মরণ বলেছেন যে, আলাউদ্দিনের এই ব্যবস্থা ছিল অবিবেচনা প্রসূত কৃত্রিম এবং অর্থনীতির নিয়মবিরুদ্ধ।

১) প্রজার হিতৌষী ব্যাবস্থা : সতীশ চন্দ্র চন্দ্রের মতে আলোচ্য সময় হিন্দু মুসলিম বণিকরা এই নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছিল তবে একইসঙ্গে সেনাবাহিনী ও সাধারণ মানুষ খাদ্যদ্রব্য ও নিয়ত প্রয়োজনীয় পণ্যের সুলভ মূল্যে উপকৃত হয়েছিল।

২ ) অবিবেচনার ফল : অধ্যাপক কে এস লাল বলেছেন আলাউদ্দিনের মৃত্যুর পর তার মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতি ভেঙ্গে পড়ে। এর কারণ হলো যে আলাউদ্দিন অর্থনৈতিক নীতি চাহিদা ও সরবরাহের সামঞ্জস্য রেখে মূল্য নিয়ন্ত্রণ করেননি। এজন্য দোয়াব ও দিল্লির সন্নিহিত অঞ্চলে কৃষক ও কারিগরদের দুঃখ কষ্টের সীমা ছিল না।

৩ ) কৃষকের দুরাবস্থা : যে কৃষকেরা ভূমি রাজস্ব হিসেবে উৎপন্ন শস্যের অর্ধেক দিত তাদেরই আবার কম দামে শস্য বিক্রি করতে বাধ্য করা হতো শস্য উৎপন্ন করার ব্যয় ও শস্য বিক্রি করার অর্থের মধ্যে সমতা বা ভারসাম্য ছিল না তাই কৃষক শস্য উৎপাদন করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলে।

৪) বনিক শ্রেণির অবক্ষয় : বণিকরা লাভ করার সুযোগ পায়নি সকলে আলাউদ্দিনের দমন মূলক নীতির ভয়ে সন্ত্রস্ত ছিল। প্রকৃতপক্ষে আলাউদ্দিন প্রবর্তিত এই ব্যবস্থা বাণিজ্য ও কৃষির ক্ষেত্রে ক্ষতিকর ছিল। বণিকদের ক্ষেত্রে যে সামান্য হারে মুনাফা নির্দিষ্ট করা হয় তাতে তাদের বাণিজ্যে উৎসাহ কমে যায়। বনিকদের স্ত্রী ও সন্তানদের রাজধানীতে জোর করে আটকে রাখা হতো যাতে বণিকেরা নিয়মিতভাবে দিল্লির বাজারে মাল সরবরাহ অব্যাহত রাখে।

মুল্যায়ন : অধ্যাপক মোঃ হাবিব মন্তব্য করেছেন যে সুলতানের ব্যক্তিগত জীবন ও স্বাস্থ্যের উপর এই পরিকল্পনার সার্থক রূপায়ণ ছিল একান্তভাবে নির্ভরশীল আলাউদ্দিন প্রবর্তিত মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও রেশন ব্যবস্থা তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে পড়ে বস্তুত আলাউদ্দিনের মূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কঠোর ছিল এবং ত্রুটিমুক্ত ছিল না কিন্তু মৌলিক ব্যবস্থা হিসেবে এর গুরুত্ব অন অস্বিকার্য । ইংরেজ ঐতিহাসিক স্টেনলি লেনপুল আলাউদ্দিনের দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতির মূল্যায়ন করে তাকে একজন রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ বা পলিটিক্যাল ইকোনমিস্ট আখ্যা দিয়েছেন।

আরও পড়ুন-> নূরজাহান চক্র

* Topic Covered :

আলাউদ্দিন খলজির বাজার নিয়ন্ত্রণ, আলাউদ্দিন খলজির বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, আলাউদ্দিন খলজির অর্থনৈতিক সংস্কার, আলাউদ্দিন খলজি, আলাউদ্দিন খলজির বাজার নিয়ন্ত্রণ নীতির সংক্ষিপ্ত বিবরণ pdf, আলাউদ্দিন খলজির বাজার নিয়ন্ত্রণ নীতি, আলাউদ্দিন খলজি বাজারদর নিয়ন্ত্রণ, আলাউদ্দিন খলজির বাজারদর নিয়ন্ত্রণ নীতি সম্পর্কে আলোচনা করো, আলাউদ্দিন খলজির মূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, আলাউদ্দিন খলজির বাজারদর নিয়ন্ত্রণ নীতি সম্পর্কে আলোচনা করো, আলাউদ্দিন খলজির বাজার নিয়ন্ত্রণ নীতির বিবরণ দাও।

Leave a Comment