হরপ্পার পতনের পর বৈদিক যুগ পর্যন্ত নগরের আর কোনো চিহ্ন থাকে না । মানুষ নগরের বদলে গ্রামবাসীতে পরিণত হয় । মানুষের বসবাসের পক্ষে অনুকূল এই সকল গ্রাম্য জনবসতি কেই জনপদ বলা হয় । এই জনপদ কথাটির আক্ষরিক অর্থ একটি জনগোষ্ঠীর নির্দিষ্ট এলাকা । ধীরে ধীরে এগুলির পরিধি ও শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং শক্তিশালী একক রাষ্ট্র রূপে আত্মপ্রকাশ করে । এগুলিই হল মহাজনপদ ।
গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাব কাল অর্থাৎ খ্রী:পূ: ষষ্ঠ ও পঞ্চম শতকে উত্তর ভারতে এমনই ষোলোটি মহাজনপদের উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘ অঙ্গুত্তরনিকায় ‘ নামক বৌদ্ধ গ্রন্থে এদের একত্রে ষোড়শ মহাজনপদ বলে অভিহিত করা হয়েছে ।
এই 16 টি মহাজনপদ হল :-
1) কাশী
2) কোশল
3) অঙ্গ
4) মগধ
5) বৃজি
6) মল্ল
7) মৎস
8) বৎস
9) চেদী
10) শূরসেন
11) অশ্মক
12) গান্ধার
13) কুরু
14) পাঞ্চাল
15) অবন্তী
16) কম্বোজ
উল্লেখযোগ্য বিষয়, অশ্মক বাদে বাকি সবই উত্তর ভারতে অবস্থিত একমাত্র অশ্মক ই দক্ষিণে অবস্থিত মহাজনপদ । বলা যায় অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী ও ক্ষুদ্রতর জনপদ গুলিকে গ্রাস করেই মহাজনপদ গুলির উৎপত্তি ।
রাজনৈতিক ব্যবস্থা :
শাসন শক্তির কথা বলা হলে যেমন রাজশক্তি ছিল তেমনই গণতান্ত্রিক মহাজনপদও বিদ্যমান ছিল । উদাহরণ হিসেবে বলা যায় প্রাচীন তথ্য সূত্রে বৃজি ও মল্ল গণরাজ্য হিসেবে পরিগণিত ।
এ যুগে বেশিরভাগ রাষ্ট্র ই ছিল রাজতান্ত্রিক ফলে রাজাই রাজ্যের সর্বেসর্বা হতেন । রাজার একার পক্ষে বৃহৎ রাজ্যের রাজকার্য তথা প্রশাসন পরিচালনা করা সম্ভব ছিল না । তাই তারা বিভিন্ন কাজে বিভিন্ন ধরনের আমলা নিয়োগ করতেন । এদের মহামাত্র বলা হত । গণরাজ্যের ছবি ছিল কিছুটা ভিন্ন । গণরাষ্ট্র গুলিতে সভা বা পরিষদের সমর্থনে একজন করে সভাপতি বা মুখ্যপ্রশাসক নির্বাচন করা হত । এদের মেয়াদ নির্দিষ্ট ছিল ।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবন :
🔷 কৃষি : মহাজনপদে শক্তি বা এলাকা বৃদ্ধির সাথে সাথে কৃষিকাজ ও কৃষি ক্ষেত্রের বৃদ্ধির ও ইঙ্গিত দেয় । মহাজনপদ গুলি যে এলাকায় ছড়িয়ে ছিল তা ছিল কৃষিজ উৎপাদনের অনুকূল । একাধিক নদনদী, যথেষ্ট পরিমাণ বৃষ্টি ও উর্বর জমি , এই তিন কারণে গাঙ্গেয় উপত্যকায় কৃষিকাজ পূর্ণ হয়ে ওঠে ।
বৌদ্ধ গ্রন্থে কৃষিকে অন্যতম ‘উৎকৃষ্ট কর্ম’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে । অষ্টাধ্যায়ী তে নীলী নামক একধরনের ফসলের কথা বলা হয়েছে । এটা আর অন্য কিছু নয়, নীল । অষ্টাধ্যায়ী তে কোদাল কে বলা হয়েছে খনিত্র । হাল চালানোর জন্য প্রশস্ত জমিকে অষ্টাধ্যায়ী তে সুহলি এবং ব্যবহারের অনুপযোগী জমিকে অহলি ও যে জমিতে লাঙল বা হল চালানো কষ্টসাধ্য তা দুর্হলি নামে পরিচিত ছিল । ফসলের মধ্যে ধানের গুরুত্ব ই ছিল সর্বাধিক । সেরা ধান ছিল শালি । যে জমিতে একে চাষ করা হত তাকে বলা হত শালেয় । মূলত বীজতলায় চারা তৈরি করে রোপণ পদ্ধতিতে শালি ধান চাষ করা হত । কৃষির উৎপাদনের একটা অংশ রাজা গ্রহণ করতেন । এর নাম ভাগ । উৎপন্ন শস্যের এক ষষ্ঠাংশ গ্রহণ করতেন বলে রাজাকে ষড়ভাগী বলা হত । পালি সাহিত্যে ছোটো কৃষকদের কুটুম্বিক আর আর বিপুল পরিমাণ জমির মালিক দের গহপতি বলা হত । তবে মনে রাখা দরকার গহপতি কিন্তু কোনোভাবেই কৃষক নয় ।
বৌদ্ধ সাহিত্যে কৃষি যেমন প্রশংসিত, তেমনই অপর একটি ‘উৎকৃষ্ট কর্ম’ ছিল গোরক্ষা বা গবাদি পশুপালন । যা এই যুগের অর্থনীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ।
🔷 শিল্প : কৃষিজ অগ্রগতির পাশাপাশি এযুগে নানা শিল্পকর্মের ও উদ্যোগ দেখা যায় । কঞ্চির কাজ করে এমন ব্যক্তিদের নলাকার বলা হত । এদের সংস্লিষ্ট গ্রাম কে নলাকার গ্রাম বলা হত । দৈনন্দিন জীবন যাপনের এক উপাদান ছিল মাটির জিনিসপত্র । যা তৈরি করতেন কুম্ভকাররা কৃষ্ণ চিক্কন মৃৎপাত্র বা কালো মৃৎপাত্র (NBPW: Northern Black Polished Ware) তৈরি হত । খুব উৎকৃষ্ট মানের মাটি ছাড়া এই মৃৎপাত্র তৈরি করা যেত না । একধরনের প্রলেপ দিয়ে, নির্দিষ্ট উষ্ণতায় পুড়িয়ে এগুলিকে আয়নার মতো চকচকে বানানো হতো ।
কারিগরি উৎপাদনে চমকপ্রদ বিকাশ দেখা যায় লৌহ উপকরণ নির্মাণ ক্ষেত্রে । কম্মার বা কর্মকাররা এই কাজ গুলি করে থাকতেন । এমনই এক কম্মার হলেন বুদ্ধের ভক্ত চুন্দ ।
কারিগর দের মধ্যে অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় সূত্রধর দের কথা যাদের পালি ভাষায় ‘বডঢকি’ বলা হয় । এরা সেই সময় কাঠ দিয়ে বাড়ি ঘর ও আসবাব নির্মাণ করতেন । তাঁতী হিসেবে তন্তুবায়দেরও উল্লেখ আছে বৌদ্ধ গ্রন্থে । পোশাক তৈরির বিশেষ কারিগরদের তুন্নবায়, সূচিকর ইত্যাদি বলা হত । এছাড়াও অলঙ্কার তৈরির কারিগর ও বিদ্যমান ছিল সেই যুগে । যারা ল্যাপিস লাজুলি বা নীলকান্তমণির মতো দুর্মূল্য পাথর দিয়ে পুঁতির মালা তৈরি করতেন ।
🔷 মুদ্রা : এইসময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য বেশ ভালো ভাবে ছড়িয়ে পড়ে ও বিনিময় প্রথার বদলে মুদ্রার গুরুত্ব অপরিসীম হয়ে ওঠে । আজকের দিনের হকারদের সাথে তুলনীয় ভ্রাম্যমাণ বনি
কদের সার্থ ও এদের মূখ্য জন কে বলা হত সার্থবাহ । পালি সাহিত্যে বার বার উল্লেখিত হয়েছে ‘কাহাপন’ বা ‘ কার্ষাপণ ‘ নামে এক মুদ্রার । প্রাচীন বৌদ্ধ সাহিত্যে ‘কার্ষাপণ’ নামে সোনা রুপা ও তামার তিন ধরনের মুদ্রার কথা বলা হয়েছে । রূপার মুদ্রা গুলি লম্বা, চৌকো নানান আকারের হয়ে থাকে । এগুলি ছাপ মারা বা অঙ্ক চিহ্নিত মুদ্রা ছিল ।
মনে করা হয় ইরানের প্রাচীন হখামনীষীয় ‘সিগলয়'(Sigloi) মুদ্রার আদলে এই যুগের মুদ্রা গুলির প্রচলন হয়েছে ।
🔷 বিবাহ : ধর্মসূত্র গ্রন্থাদি তে আট রকমের বিবাহের উল্লেখ পাওয়া যায় । এগুলি হল –
1 thought on “ষোড়শ মহাজনপদ : বিস্তারিত আলোচনা”