* রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত কি?
বাংলার জমিদারদের সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও উত্তর ভারতের মহলওয়ারি বন্দোবস্ত প্রচলিত ছিল। মাদ্রাজে কয়েকটি এলাকা বাদে সর্বত্র যে ব্যবস্থার প্রচলিত ছিল তা হল রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত। রায়ত কথার অর্থ হল কৃষক। এ ব্যবস্থা জমিদারি ও মহলওয়ারি বন্দোবস্ত থেকে আলাদা। জমিদারি ব্যবস্থায় জমিদারদের সঙ্গে এবং মহলওয়ারি বন্দোবস্তে গ্রাম সমাজ ও মহলের সঙ্গে জমি বন্দোবস্ত করা হতো। রায়তওয়ারি বন্দোবস্তে সরাসরি কৃষকদের সঙ্গে জমি বন্দোবস্ত করা হতো অর্থাৎ এই ব্যবস্থাই সরকার ও কৃষকদের মধ্যে জমিদার শ্রেণির মত কোন মধ্যবর্তী স্তর থাকত না।
এই ব্যবস্থায় সরকার নিজস্ব কর্মচারী মারফত সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে নগদে রাজস্ব আদায় করতেন। রাজস্ব নির্ধারণ করার আগে প্রত্যেক জমি জরিপ করা হতো এবং তা থেকে কতটা ফসল উৎপন্ন হতে পারে তার হিসাব করা হত। তারপর সরকারের প্রাপ্য রাজস্বের হার নগদ অর্থে স্থির করা হতো। প্রত্যেক জমি একজন রায়তের নামে নথিবদ্ধ করা হতো।
জমিদারদের বাদ দিয়ে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করার পরিকল্পনা করেছিলেন মুনরোর মতো কিছু সরকারি কর্মচারীরা। কেউই বড় পন্ডিত বা বিশেষজ্ঞ বা তাত্ত্বিক ছিলেন না; যুদ্ধবিগ্রহ এবং কূটনীতি ছিল এদের প্রধান কাজ। কিন্তু প্রত্যক্ষ ও বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এরা বুঝেছিলেন যে দক্ষিণ ভারতে রায়তওয়ারি বন্দোবস্তই উপযুক্ত। এরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন এবং চিরস্থায়ী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একরকম জেহাদ ঘোষণা করেই এরা মাদ্রাজের বিকল্প হিসেবে রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত করে তুলতে চেয়েছিলেন।
* প্রবর্তন :
ইতিমধ্যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কিছু দোষ-ত্রুটি ধরা পড়ায় এদের মতামতের গুরুত্ব অনেকটা বেড়ে যায়। বেন্টিঙ্ক ১৮০৬ সালের জুন মাসে লেখা এক মিনিটে রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের স্বপক্ষে তিনটি যুক্তি দেখেছিলেন।
প্রথমত, দক্ষিণ ভারতে যেহেতু কোন বড় জমিদারি অস্তিত্ব ছিল না সেহেতু সেখানে নতুন করে তা গড়ে তোলার অর্থই হচ্ছে অনাবশ্যক সমস্যা সৃষ্টি করা।
দ্বিতীয়তঃ বাংলার মত প্রভাবশালী জমিদার বা পলিগগারের তুলনায় ছোটখাটো ভূ সম্পত্তির মালিক, কৃষক সম্প্রদায়কে বশে রাখা স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে অনেক সহজ কাজ।
তৃতীয়তঃ রায়তওয়ারি বন্দোবস্তে উৎপাদিকা শক্তির ভিত্তিতে মাঝে মাঝে জমির খাজনা পুনঃনির্ধারণ করা সম্ভব হবে।
অন্যদিকে জেমস মিল তার ইতিহাসে কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করে রায়তওয়ারি ব্যবস্থার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেন। তিনি মনে করতেন যে, ভারতের উত্থান ও উন্নয়নের একান্ত ভাবে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার ও তার নিরাপত্তার উপর নির্ভরশীল। মিল ও বেন্থাম দুজনেই জমি জরিপ ও তার ভিত্তিতে জমির উপর কৃষকদের অধিকার নথিবদ্ধ করার উপর গুরুত্ব দিতেন। কারণ এর উপর ভিত্তি করে একটি সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভবপর ছিল। এ ধরনের ব্যবস্থা জমিদারি প্রথাতেই নয় একমাত্র রায়তওয়ারি প্রথাতেই গড়ে তোলা সম্ভব ছিল। অবশ্য রাজস্ব চিরদিনের জন্য বেঁধে দেওয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন।
মিল চেয়েছিলেন রাষ্ট্রই জমিদারের স্থান দখল করুক এবং দীর্ঘমেয়াদী জমি ব্যবস্থা করে প্রজাদের জমিতে পুঁজি লগ্নী করতে উৎসাহ দিক। ইংল্যান্ডের কৃষকদের মতো ভারতীয় কৃষকও জমিতে তার অধিকার সম্পর্কে নিশ্চিত হোক। কর্নওয়ালিসের মতো বেন্টিঙ্কও ছিলেন ইংল্যান্ডের অভিজাত জমিদার বংশের সন্তান। কিন্তু তিনি ও মনরোর সঙ্গে একমত হন মাদ্রাজে আসার কিছু পর থেকেই তিনি রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করে রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত একটি চিরস্থায়ী ব্যবস্থায় পরিণত হবে।
১৭৯২ সালে ইংরেজরা যখন বরামহল দখল করে তখন ক্যাপ্টেন রিড এবং টমাস মনরো সেখানে রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন কিন্তু সরকার তখন যে পরিমান অর্থ দাবি করতেন অর্থাৎ উৎপন্ন শস্যের অর্ধেক অংশ তা অত্যাচারের নামান্তর হয়ে দাঁড়ায় ও কৃষকদের দুর্দশা শেষ ছিল না। মনরো নিজেও বুঝতে পেরেছিলেন যে কৃষকদের উপর অত্যাধিক বোঝা চাপানো হয়েছে। সুতরাং ১৮০৭ সালে তিনি প্রস্তাব করেছিলেন যে কৃষকদের উপর এই দাবির পরিমাণ অর্ধেক অংশ থেকে তিন ভাগের এক ভাগ করা হোক। কিন্তু কোম্পানির আর্থিক দুরবস্থার কথা চিন্তা করে লন্ডন কর্তৃপক্ষ তার প্রস্তাবে কান দেননি।
এই ঘটনা প্রমাণ করে যে কোম্পানি কৃষক বা প্রজাদের স্বার্থের চেয়ে কোম্পানি নিজের স্বার্থ অনেক বড় করে দেখতো। যাইহোক ১৭৯২ থেকে ১৮০১ সালের মধ্যে সালেম, কোয়েম্বাটুর, মাদুরা, মালাবার, কানাড়া, কুডাপ্পা, বেলারি ও কুড়ুল রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হয়। কিন্তু তখনই দক্ষিণ ভারতে একটি সুস্পষ্ট রাজনীতি গড়ে ওঠেনি। বস্তুত ১৮০৭ সালে থেকে ১৮২০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে দক্ষিণ ভারতে কি ধরনের রাজস্ব ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে তা নিয়ে তর্ক বিতর্ক চলছিল। অনেকে এখানে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পক্ষে ছিলেন।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত জমিদারি ব্যবস্থার সমর্থকেরা ক্রমশ পিছু হটতে থাকেন অনেক জমিদারি তাদের দেয় অর্থ প্রদান করতে ব্যর্থ হন ফলে তাদের জমিদারি উঠে যেতে থাকে। ১৮৩০ সালে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির এক তৃতীয়াংশ জমিদারদের অধিকারভুক্ত ছিল কিন্তু এরপর থেকে জমিদারদের জমিদারি লাটে উঠে যেতে থাকে ১৮৫০ সালের মধ্যে প্রায় ৬০০টি জমিদারি সরকারি ক্ষার জমিতে পরিণত হয়। সুতরাং মাদ্রাজে জমিদারি ব্যবস্থা প্রবর্তনের আশা বিলীন হতে থাকে। অন্যদিকে মাদ্রাজের বোর্ড অফ রেভিনিউ। মৌজাভিত্তিক রাজস্ব ব্যবস্থার পক্ষপাতী ছিল। কিন্তু কোম্পানির কোনো পক্ষেই কান দেয়নি তারা সরাসরি প্রজাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার পক্ষে ছিলেন। সুতরাং মনরোর রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের দিকে সবাই ঝুকে পড়েন।
* বৈশিষ্ট্য :
১) রায়তওয়ারি বন্দোবস্তে সরকার নিজস্ব কর্মচারী মারফত সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে নগদে রাজস্ব আদায় করতেন।
২) রায়তওয়ারি বন্দোবস্তে সরাসরি কৃষকদের সঙ্গে জমি বন্দোবস্ত করা হতো তাই ব্যবস্থাই সরকার ও কৃষকদের মধ্যে জমিদার শ্রেণির মত কোন মধ্যবর্তী স্তর থাকত না।
৩) প্রত্যেক জমি একজন রায়তের নামে নথিবদ্ধ করা হতো। সেই রায়ত সরকারের কাছে রাজস্ব দিতে বাধ্য থাকত।
৪) রাজস্ব নির্ধারণ করার আগে প্রত্যেক জমি জরিপ করা হতো এবং তা থেকে কতটা ফসল উৎপন্ন হতে পারে তার হিসাব করা হত। তারপর সরকারের প্রাপ্য রাজস্বের হার নগদ অর্থে স্থির করা হতো
* ত্রুটি ও প্রভাব/ ফলাফল :
১৮২০ সাল থেকে ১৮২৭ সাল পর্যন্ত মাদ্রাজের গভর্নর ছিলেন স্যার টমাস মুনরো এবং তার সময়ে মাদ্রাজের যে সমস্ত অঞ্চলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবাহিত হয়নি সেখানে রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হয়। তার প্রচেষ্টাই কৃষকের রাজস্ব উৎপন্ন ফসলের এক দ্বিতীয় অংশ থেকে এক তৃতীয়াংশ অংশ করা হয়। কিন্তু এই দাবিও প্রজাদের পক্ষে দুর্বহ ছিল। তাছাড়া উৎপন্ন ফসলের পরিমাণ অথবা বাজার দর যাই থাকুক না কেন, তা নগদে আদায় করা হতে বলে প্রজাদের খুব অসুবিধা হতো।
দ্বিতীয়ত, এই টাকা আদায় করতো সরকারি কর্মচারীরা। যাদের বেতন ছিল খুবই অল্প হলে তারা জোর জবরদস্তি করে যাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করতো এর ফলেও তাদের দুঃখ-দুর্দশার পড়তে হয়। তবুও যতদিন পর্যন্ত মনরো জীবিত ছিলেন যাতে প্রজাদের উপর কোন অন্যায় অত্যাচার না করা হয় সেদিকে তার কড়া নজর ছিল। কিন্তু ১৮৮৭ সালে তার মৃত্যু হলে ৩০ বছর ধরে অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। বিভিন্ন জেলা কালেক্টরদের বিবরণী প্রজাদের দুঃখ দুর্দশার বর্ণনা পাওয়া যায়। রাজস্ব দেবার জন্য যে অত্যাচার ও নিষ্ঠুরতা আশ্রয় নেয়া হতো তার মর্মস্পর্শী বিবরণ সমসাময়িক বিভিন্ন নথিপত্রে লিপিবদ্ধ আছে।
আসলে মাদ্রাজের রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত প্রবর্তনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি করা। কৃষকদের অবস্থার উন্নতির জন্য সরকারের কোন মাথাব্যথা ছিল না। কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি রাজস্ব আদাই করলে সরকারের আয় বাড়বে এরকম ধারণার বশবর্তী হয়ে এই ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল। অবশ্য মাদ্রাজের সর্বত্র অবস্থা এক ধরনের ছিল না। কোন কোন জেলায় যেমন কোয়েম্বাটুর তাঞ্জাভুর প্রভৃতি জেলায় কৃষকদের অবস্থা ভালো ছিল।
অবশেষে ১৮৫৫ সালে সরকারও রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের চড়াহার ও প্রজাদের দুঃখ দুর্দশার কথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়। এর ফলে মাদ্রাজের কৃষি উন্নয়ন ব্যাহত হয়েছিল। দুর্নীতিও বেড়ে চলেছিল। জমিজমা ও সম্পত্তির উপর লোকের আকর্ষণ কম হচ্ছিল। এই অবস্থায় যাতে উন্নতি হয় সেদিকে নজর দেওয়া ছাড়া কোম্পানির অন্য কোন পথ খোলা ছিল না, ফলে ১৮৫৫ সালে সরকার মাদ্রাজে জমি জরিপ ও বন্দোবস্ত করার জন্য নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করে। শেষমেশ রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের অবসান ঘটে।
আরও পড়ুন -> মহলওয়ারি বন্দোবস্ত : প্রবর্তন, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব
F.A.Q :-
১) রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত কে চালু করেন ?
উঃ আলেকজান্ডার রিড ও স্যার টমাস মুনরো রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত চালু করেন ।
২) রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হয়েছিল ? রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত কে প্রবর্তন করেন
উঃ আলেকজান্ডার রিড ও স্যার টমাস মুনরো ১৮২০ সালে রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত চালু করেন ।
৩) রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত কবে চালু হয় ?
উঃ ১৮২০ সালে রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত চালু হয় ।
৪) রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত কোথায় চালু হয়? / কোন প্রেসিডেন্সিতে রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত চালু হয়েছিল ?
উঃ ১৮২০ সালে বোম্বাই ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত চালু হয় ।
৫) রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের জনক কে ? / রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত কে প্রচলন করেন ?
উঃ আলেকজান্ডার রিড ও স্যার টমাস মুনরো রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের প্রচলন করেন ।
* Topic Covered :
রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত, রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত কি, রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত কে চালু করেন, রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হয়েছিল, রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত কে প্রবর্তন করেন, রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত কী, রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত কবে চালু হয়, রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত pdf, রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত বৈশিষ্ট্য, রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত কোথায়, রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত চালু হয়, রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত চালু হয় কোথায়, রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত কাকে বলে, কোন প্রেসিডেন্সিতে রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত চালু হয়েছিল, রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত টিকা, রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের জনক কে, রায়তওয়ারি বন্দোবস্তের বৈশিষ্ট্য ।
1 thought on “রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত কি ? বৈশিষ্ট্য প্রভাব ও ফলাফল”